মেয়ে তুমি কালো !

মেয়ে তুমি কালো !

populationresistance.org

populationresistance.org

আফিফা আফরিন, অতিথি ব্লগার

এই লেখাটা আমার হবু শ্বাশুড়ি আম্মাকে উৎসর্গ করা !!

 হ্যাঁ, আমি একটা মেয়ে এবং আমি কালো। অনেকে ভদ্রতা করে বলে শ্যামলা। তো?

আমি কালো জন্য কি আমাকে সারা ক্ষণ প্রমাণ করতে হবে যে, কালো হয়েছি তো কি হয়েছে, আমার চোখ মায়াময় কিংবা আমার হাসিতে মুক্তো ঝরে কিংবা আমি লেখাপড়ায় ভালো হয়ে আমার কালোত্ব পুষিয়ে দেব!

 থামেন,  কোন কিছু দিয়েই পুষিয়ে দেয়া যাবে না যে আমার গায়ের রং কালো।

 আমার গায়ের রং কালো, জেনেটিকালি কালো। আমার মায়ের গায়ের রং তীব্র সাদা, আর বাবারটা তীব্র কালো। মেন্ডেলের বংশগতির সূত্র মানলে আমার ফিনোটাইপ কালোই হবে, ‘প্রচ্ছন্ন কালোএবং জিনোটাইপ হবে মিক্সড অর্থ্যাৎ সাদা এবং কালো জীনগুলো আমার প্রতিটি কোষে পাশাপাশি বিরাজ করবে। সুতরাং আমার গায়ের রং কালোসেটা আমার জেনেটিক বৈশিষ্ট্য এবং কোন ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী/ হোয়াইটেনিং ক্রিম/ সাবান/ পাউডার মেখে সেটা সাদা হবে না।

 সেটা সাদা করার ইচ্ছাও আমার নাই। আমার মনেও থাকেনা যে আমি কালো। তবে মনে করিয়ে দেয়ার লোকের অভাব হয় না। এই যেমন, অনেকদিন পরে দেখা, আরে তুই তো কালো হয়ে গেছিস, যত্ন নিস না ত্বকের ! এমনকি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিউটি টিপস দেয়ার লোকেরও অভাব হয় না। ভাই আমি বিউটি টিপস চাই না, আমি এমনিতেই সুন্দর, তোমার চোখে না হোক আমার চোখে। ওই চকচকে গহনা বা চটকদার পোষাকে ধুয়ে আমি পানি খাই না, আমার বহুত কাজ করার আছে এই পৃথিবীর সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য।

 যাক গে, শুরুতেই বলেছি এই লেখাটা আমার হবু শ্বাশুড়ি আম্মাকে উৎসর্গ করা!! সেই বেচারি (পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি তার অসহায়ত্ব কল্পনা করে) এক বহিরাগত মানুষের কাছে কেন তার ফর্সা ছেলে আমার মত কালো মেয়েকে পছন্দ করে সেই ব্যাখ্যা দিচ্ছিলো। আমার সামনে না, আমি ঘটনা শুনেছি অন্য কারো মুখে। সেই বহিরাগত মানুষের প্রশ্ন ছিলো, “আপনার ছেলে আর মেয়ে পাইলো নাহ। বেচারী হবু শ্বাশুড়ি আম্মা তখন আমাকে ডিফেন্ড করার জন্য আমি কেমন জুয়েল ছাত্রী, কত ভালো চাকুরি করি সেই সবের বর্ণনা দেয়া শুরু করলো। ধন্যবাদ হবু শ্বাশুড়ি আম্মা, তবে আমি আপনার সাথে একমত নই। দুঃখিত। এবং যদিও জেনেটিকালি ৭৫/২৫ সম্ভাবনা আছে, তারপরও আপনার নাতি পুতি সাদা সাদা বা তথাকথিত আপনার ছেলে মেয়ের মতো সুন্দর হবে সেই গ্যারেন্টি আমি দিচ্ছি না। এক কথায় আমি গুষ্টিই কিলাই। আমার ছেলে/মেয়ে আমার মত হবে, সেইটাই আমি ভাবি। তবে সেইগুলি মাকাল ফল হবে না, সেইটা আমার বিশ্বাস। আমার এডুকেশনাল কোয়ালিটি, আমার বেটার জব এসব কোন কিছুই আমার গায়ের রং কালো থেকে সাদা করবে না, এমন কি আমি পিএইচডি করলেও কালোই থাকবো সাদা না যতক্ষন না পর্যন্ত আপনি সেটা স্বাভাবিক দেখেন।

সুতরাং সেটা স্বাভাবিক দেখেন। এই স্বাভাবিক কথাটাই কেউ মেনে নেই যা জন্যই তৃতীয় বিশ্বের ঘরে ঘরে বর্ণবাদ চলে এবং চলে আসছে। অনেকে এই বর্ণবাদের উৎস দেখেন উপনিবেশিকতার বিকাশের হাত ধরে। কিন্তু বিষয় হলো, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতেও এর অস্তিত্ব দেখা যায়। রাধা কৃষ্ণের প্রেমেও রাধার রূপের যে বর্ণনা তাতে রাধা অতীব সুন্দরী এবং ফর্সা। দেবী দুর্গার রূপতো এই যুগেও সমাদৃত। আর সীতা! সেটা ভুমিকায় গেলে এই প্রবন্ধ প্রয়োজনের চেয়ে বড় হয়ে যাবে। তবে কালীদেবীত্বের একটু ভূমিকা কড়তে ছ্যাই, কেননা কালো মেয়েদের সাথে কালী দেবীর একটা তুলনা চলে আসে। কালীর একটা রূপ তীব্র রাগ, ক্রোধ আর প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ যেটাকে কিনা নারীবাদী স্কলারশীপে একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যেমন কালীর স্বরুপ নারীর আত্মপ্রত্যয়ের প্রতীক। তবে কালো মেয়েরা কালীর সাথে বেশি যায় এইটা মানতে আমি নারাজ। তারপর আসেন, মধ্যপ্রাচ্যে। ইসলাম ধর্মেও রূপবতীদের (অবশ্যই ফর্সা) আলাদা মর্যাদা আছে, অন্যান্য ধর্ম নিয়ে আমার বিশেষ জানাশোনা নেই, থাকলে উল্লেখ করা যেত। এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো, ধর্মগ্রন্থ, কাব্য/সাহিত্য সবখানেই যদি এই ফর্সা কালো নিয়ে এত কথা উল্লেখ থাকে, তাহলে উপনিবেশিকতার উপর দায় চাপানোর দরকার আছে কি? আসলে এইটা আমাদের মনের ভিতর গেথে থাকা কাঁটা বর্ণবাদের কাঁটা যেইটা আমাদের কোন ধর্মকেই নিরপেক্ষ হয়ে উঠতে দেয় নি। কোন ধর্মের মহাপুরুষই এই বিতর্কের উর্দ্ধে উঠতে পারেন নাই, আমরাতো কোন ছার ! সুতরাং বর্ণবাদের উৎস উপনিবেশবাদ বলে গালমন্দ করার কিছুই না, বরং এই বিষয়টা হিসটোরিকাল। এখন আবার প্রশ্ন উঠবে, আগে তো কালোরাই সুন্দর ছিলো যতদিন কালোদের হাতে ক্ষমতা ছিলো। ভাই থামেন, সে কেবলই ইতিহাস, কালোরা কবে সুন্দর ছিলো আর কবে তাদের ক্ষমতা বেশি ছিলো সেটা আলোচনায় না আসাই ভালো, কেননা সে ইতিহাস বর্তমানকে প্রভাবিত করছে না।

আসল আলোচনায় ফেরত আসি, “আমি কালো। তো? কালোত্ব পুষিয়ে দেয়ার জন্য আমার জন্ম হয় নাই, আমার কোয়ালিটি গুলো আমার গায়ের রং থেকে আসে নাই, আমি প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে নারাজ যে, ফ্রেশই সুন্দর বা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী ফাউন্ডেশনের সাহায্য বিয়ের আগেই আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এইসব হ্যান ত্যান চিন্তা করে আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে আমি রাজি না। মধ্যবিত্ত সংসারে জন্মেছি জন্য পুতুল পুতুল সেজে বিবাহ করার বাসনা আমার নাই। আমার ইচ্ছে হলে আমি সাজতে পারি, নাচতে পারি, ফ্রেশ থাকতে পারি বা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী ফাউন্ডেশনের সাহায্য না নিয়েও মেধার জোরে, পরিশ্রমের জোরে প্রতিষ্ঠিতও হতে পারি। আমার ইচ্ছে হলে শাড়ি পরতে পারি, ইচ্ছে হলে ফতুয়া বা শার্ট।

সব কিছুই আমার চয়েস, আমার সিদ্ধান্ত!

আমি কালো মেয়ে সত্য, আমার গায়ের রং অস্বীকার করার সামর্থ্য আমি কেন স্বয়ং ঈশ্বরেরও নাই। সুতরাং আমি কালো, এটাই সত্য, এটাই স্বাভাবিক। আপনি সাদা  সেটাও সত্য, সেটাও স্বাভাবিক।

সুতরাং মেয়ে তুমি কালো, এইটা বাদ দেন।

লেখাটি আগে womenchapter.com ছাপা হয়েছিল.আফিফা আফরিন, বেসরকারি কর্মকর্তা (afifa101@gmail.com)



Categories: যাপিত জীবন

Tags: , , , ,

2 replies

  1. লেখা টা পড়ে মনে হচ্ছে প্রচন্ডরকম ইনফেরিওর কমপ্লেক্সিটি তে ভোগা কোন মানুষ প্রচন্ড শক্তি সঞ্চয় করে লিখতে বসেছেন।
    ইসলাম ধর্মে কোথাও সাদা নারীদের কে মর্যাদার আসনে বসানো হয়েছে কিনা তার দলিল দাবী করছি।
    মানুষ মানুষকে মুল্যায়ন করে তাঁর গুনের কারনে, তাঁর কর্মের কারনে। সুতরাং মানুষের সাথে চলাফেরা করুন। তাহলে এইসব নিয়ে ভাবার দরকার হবে না।

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: