“বর-পরং” এ যাওয়া আমার বোনের খবর যদি কেউ এনে দিতে পারতো! মায়া দেবী চাকমা


মায়া দেবী চাকমা- আরেক ডুবুরীর আত্মকাহিনী ঃ

অনুলিখনঃ সমারী চাকমা

আলাপের শুরুঃ

আমার নাম মায়া দেবী চাকমা। আমার বয়স এখন পচাঁশি(৮৫)বছর হবে অথবা তারও বেশী হতে পারে। নিজের সঠিক বয়স বলতে পারবোনা। তবে এটাতো সত্যি আমার এখন শশ্মানের যাওয়ার জন্য সময় হয়ে এসেছে। এই বয়সের কারণে  জীবনের অনেক কিছু, অনেক দুঃখের স্মৃতি ভূলে গেছি। এই জীবনে সুখ-দুঃখ, কষ্ট-যন্ত্রণা কমতো পাওয়া হলোনা এখন এই বয়সে এসে সেসব প্রায় ভূলে গেছি কিন্তু একটা যন্ত্রণার কথা আর ভূলে থাকা হয়না আমার। সেই যন্ত্রণাটা হচ্ছে আমাদের পরিবারের মেজ মেয়ে আমার ছোট বোন বন দেবী চাকমাকে হারিয়ে ফেলা। তার খবর কাপ্তাই গোদা/কাপ্তাই বাঁধ পরবর্তীতে আর না পাওয়ার তাকে না দেখার যন্ত্রণাটা দিনরাত আমাকে কষ্ট দিয়ে থাকে।

কাপ্তাই বাঁধের পানি এসেছিল ১৯৬০-৬৪ সালের ভিতর। আমার সেই মেজো বোন বন দেবী চাকমা তার স্বামীর পরিবারের সাথে সেই কাপ্তাই বাঁধের পর পরই ‘বর-পরং’এ চলে যায়। সেই যে গেলো এত বছর পর আমরা আজো তার খবর জানিনা। কোথায় আছে কেমন আছে বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে সেসবের কোন খবর আমাদের জানা নেই। জানো “বর-পরং”এ হারিয়ে যাওয়া সেই মেজো বোন বন দেবী চাকমার সাথে স্বপ্নে  প্রায়ই আমার দেখা হয়। সে তার সুন্দর হাসিমুখ ‍নিয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে, আমরা একসাথে বসে আমাদের জমে রাখা সুখ দুঃখের গল্প করছি। আমরা বাড়ির সকলে তার বর-পরং যাওয়া কথা শুনছি! কিন্তু ঘুম থেকে জাগার পর বুঝতে পারি আমি আসলে স্বপ্ন দেখেছি। তখন কীযে যন্ত্রণা হয় প্রাণ ছটফট ছটফট করতে থাকে তার খবর পাওয়ার জন্য তাকে একবার দেখার জন্য। তোমাকে কেমন করে বুঝাবো আমার এই বোনটির জন্য আমার প্রাণ দিনরাত  কাঁদে। কী লাল টুকটুকে ফর্সা ছিল আমার এই বোনটি ঠিক একেবারে আমার মায়ের মতো। কিন্তু আমার এই বোনটির কোন খবরইতো আর পেলাম না আমরা। কেমন আছে কোথায় আছে সে? আজো কি বেঁচে আছে? তার ছেলেই বা থাকে কোথায়? এরকম কতো প্রশ্ন মনের ভিতর প্রতিনিয়ত আসে যায়। যদি কোনভাবে একটা খবর পাওয়া যেতো আমার এই বোনটির! মাঝে মাঝে ভাবি এই বোনটির খবর না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়েই হয়তো আমি একদিন মারা যাবো। দেখতে দেখতে আজ প্রায় পঞ্চাশ বছরের বেশী হয়ে গেলো সে আমাদের মাঝ থেকে কোন খবর ছাড়া একেবারে ‘নাই’ হয়ে গেছে। কেউ যদি তার একটু খবর এনে দিতে পারতো তাহলে তার অনেক পূণ্য হতো। এই কাপ্তাই গোদা/কাপ্তাই বাঁধ আমাদের বোনকে আমাদের কাকাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কোথায় যে গেলো সব (র্দীঘশ্বাস। যিনি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন তাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন তুমি যদি পারো একটু আমার বোনের খোঁজ এনে দাও। তোমারতো কতো মানুষের সাথে পরিচয় আছে)।

শিলছড়ি দোর টু ঝর নাল আদামঃ

আমার বাবার নাম মৃত মোদন মোহন চাকমা এবং মা মৃত লাল পুদি চাকমা। আজু/দাদু মৃত ফরেয়ে কার্বারী আর নানু উমেশ্বরী’মা(নানুর আসল নাম ভূলে গেছি)। আমার জন্মের আগে আজু ফরেয়ে কার্বারী তার পরিবার নিয়ে পুরাতন রাংগামাটির নীচে শিলছড়ি দোর নামক এক জায়গায় বসবাস করতেন। আমার জন্মের পরপরই আজু সেই গ্রাম ছেড়ে ঝর নাল আদাম/গ্রাম, হাক্কস্সে/হাকপোজ্যে দোর জায়গায় বসতি গড়ে তোলেন। আমরা বংশা গোজার ফেমা গোষ্ঠীর বংশধর। আমার আজু/নানুর চার(৪)পুত্র তিন(৩) কন্যা। সবার বড় জন ছিলেন হরি মোহন চাকমা এরপর জগত মোহন চাকমা, তিনি তখনকার সময়ে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তারপর মোদন মোহন চাকমা, মুদুরো মুখী চাকমা, মোজা গালি চাকমা, মদন মুখী চাকমা, এবং সবার ছোট মুদুরো মোহন চাকমা। আমার বাবা সেসময় গ্রামে ডাক্তারী করতেন। তাই তখন ডাক্তারের মেয়ে হিসেবে আমাদের সকলেই চিনতো। ( হাসি)

আমার বাবা মোদন মোহন এর সাথে বিয়ে হয় তখনকার মেইনির কূলের নিবাসী(এখনকার দিঘীনালা) লাল পুদি চাকমার সাথে। আমার মা ‍ছিলেন তাঁর নামের প্রতিরূপ। দেখতে একেবারে লাল টুকটুকে ফর্সা ‍ছিলেন। আমার মায়ের বাবা আর বাবার বাবা মানে আমার দুই আজু ছিলেন দুইবোনের ছেলে। আমাদের চাকমা ভাষায় একটা কথা আছে “ পুরন বান্ ছিনি যাদে যাদে নুয়ো বান্ বানানা“ মানে পুরাতন সর্ম্পক ছিন্ন হবার আগে আবার নতুন করে সর্ম্পক করা। তাই আমার দুই আজু মিলে ঠিক করলেন নিজেদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে আবার পরস্পরের ভালোবাসার পারিবারিক সর্ম্পক টিকিয়ে রাখবেন। তাই আমার বাবা-মায়ের বিয়ে হলো পুরনো পারিবারিক বন্ধন আবার নতুন করে জোড়ালো করার জন্য।

আমরা দশ (১০) ভাইবোন। আমি সবার বড়, তারপর পদ্মাংগনী চাকমা, বিনোদ চন্দ্র চাকমা, সুবল চন্দ্র চাকমা, লক্ষী চন্দ্র চাকমা, দয়াল চন্দ্র চাকমা, বন দেবী চাকমা (বর- পরং নিবাসী), পূর্নিমা দেবী চাকমা এবং সবার ছোট শংকচূড় চাকমা।

আমার মা টিয়ে গোজার বংশের মেয়ে। আমার মায়ের মাত্র তের (১৩) বছর বয়সে বিয়ে হয়। আর আমার চৌদ্দ (১৪) বছর বয়সে বিয়ে হয়। আমাদের সময়ের ছোটবেলার সময়টা খুবই আনন্দের ছিল। গ্রামে স্কুল ছিলনা তাই পড়াশুনার কোন বালাই ছিলনা। তবে আমাদের বাড়িতে শিক্ষক রাখা হয়েছিল যাতে আমরা সকলেই লেখাপড়া শিখতে পারি। আমরা যৌথ পরিবারের সন্তান ছিলাম। তাই অনেক ভাই-বোন একসাথে বড়ো হয়েছি। আর আমি আমার বাবা-মা’র প্রথম সন্তান ছিলাম তাই খুবই স্বাভাবিক ভাবে একটা আলাদা আদর যত্ন পেয়ে বড়ো হয়েছি ।

আগেই বলেছি আমার জন্মের পরপরই আজু শিলছড়ি দোর থেকে ঝর নাল আদাম/গ্রামে বসতি গড়ে তুলেন।  তখনতো এখনকার মতো এতো বেশী মানুষ-জন ছিলনা, এই সময়ের মতো জায়গা জমি নিয়ে মারামারি কাটাকাটি ছিলনা। যে যতটুকু চাইতো ততটুকু জমি নিয়ে সে চাষ করতে পারতো সে নিয়ে কোন ঝামেলা ছিলনা। তো আজুর ইচ্ছেতে আমাদের পরিবারের সবাই ঝর নাল আদাম/গ্রামে চলে আসে তারপর নিজের মতো করে জায়গা জমি নিয়ে নতুন জীবন শুরু করে। শুনেছি তখন নাকি আমাদের সেই নতুন জায়গা ’শন বন(বাড়ির চাল বানানোর এক ধরনের পাতা’ এ ভর্তি ছিল। তাই নতুন গ্রাম পত্তন করার আগে সেই জায়গাকে শন বন মুক্ত করতে দূর থেকে বাংগালীদের আনা হয়েছিল। বাংগালীরা এসে সেসব শন কেটে নিয়ে নৌকায় তুলে তাদের দেশে নিয়ে যেতো। তখন আমাদের সেই এলাকায় কোন বাংগালী ছিলনা। শুধু লংগদু বাজারে দুই/তিন(২/৩) জন বাংগালী ছিল যারা ব্যবসা করতো। আমি কিন্তু সেই বৃটিশ আমলের কথা বলছি। আমার জন্ম হয়েছিল বৃটিশ আমলে। সেই আমলে গ্রামের কার্বারীদের এবং সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন বাংগালী আমাদের এলাকায় ঢুকতে পারতোনা।

বৃটিশরা চলে যাবার পর পাকিস্তান আমল শুরু হয়। কিন্তু আমরা তখনও একটুও কল্পনা করিনি বা করতে পারিনি যে আমাদের দেশটা শুধু বাংগালীতে ভরে যাবে। তখন কি ছিল আর এখন কি হয়ে গেলো(র্দীঘশ্বাস)।

আমার জন্ম পুরাতন গ্রাম শিলছড়ি দোর হলেও বেড়ে উঠলাম নতুন গ্রামে নতুন জায়গায়। আমাদের এই পুরাতন জায়গা ছেড়ে নতুন জায়গা যাওয়ার কারণ হিসেবে আজুর কাছে শুনেছি  শিলছড়ি দোরে নাকি কৃষিজমির পরিমান কম ছিল তাই গ্রামের লোকজনকে জুমের উপর র্নিভরশীল থাকতে হতো। আর নতুন জায়গায় কৃষিজমির কোন অভাব ছিলনা। দুনকে দুন ধান্য জমি এই এলাকায় পাওয়া গেলো। আর এসব জমি পেতে তখন কাউকে কোন টাকা দিতে হয়নি। শুধু জলা জংগল পরিস্কার করে নিয়ে নিজের মনে করে চাষ শুরু করলেই সেই জায়গা তার হয়ে যেতো। কতো সুখের দিন ছিল আমাদের। কিন্তু বাংলাদেশ হবার পর বাংগালীরা আসা শুরু করলে আমাদের সকল সুখ শান্তি শেষ হয়ে গেলো।

এখন যেভাবে গ্রামে গ্রামে বৌদ্ধ হিয়ং/বৌদ্ধ মন্দির এবং স্কুল দেখা যায় সেসময় এসব কোন কিছুই ছিলনা। তখন শুধুমাত্র আমাদের গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে হাক্কসসা দোর/হাকপোয্যে দোর নামের একটা এলাকায় একটি প্রাইমারী স্কুল ও একটি বৌদ্ধ হিয়ং/মন্দির ছিল। সেই স্কুলে গিয়ে আমার ভাইরা পড়াশুনা করতে পারলেও আমার আর আমার বোনদের সেই স্কুলে যাওয়া হয়নি কিন্তু অ, আ, ই বাংলা র্বণমালা শেখাতে বাড়ীতে একজন শিক্ষক রাখা হয়েছিল আমাদের জন্য। সেই সাথে আমাদের চাকমা র্বণমালা শিখতে হয়েছিল। আজু বলতেন নিজের ভাষা না শিখলে অন্য ভাষা শেখা যায়না। আগে নিজের ভাষা ভালো করে শিখতে পারলে পরে অন্য ভাষাও তাড়াতাড়ি শিখতে পারবে। এটা ছিল আজুর উপদেশ। তাই বাড়িতে শিক্ষক রেখে আমাদের লেখাপড়া শেখানো হয়েছিল।  কিন্তু ইংরেজী র্বণমালা আমাদের কেউ শিখতেও বলেনি আমাদের শিক্ষকও শেখাননি।

 

আমাদের সেই ঝর নাল গ্রাম ঃ

আমাদের ঝর নাল আদাম কেমন ছিল? আমাদের এই গ্রাম খুব  ”বলপিয়ে” মানে খোলামেলা ছিল। ঝর-নাল নামে একটা ছোট্ট ছড়া ছিল সেটার নামেই ঝর নাল গ্রাম। আমারতো আমাদের সেই পুরনো শিলছড়ি দোর আদামটা দেখা হয়নি তবে বাবাদের মুখে শুনতাম সেই গ্রামের চাইতে এই গ্রাম অনেক বেশী সুন্দর আর বলপিয়ে ছিল। আমরা কাজলং নদীর পাড়েতে(কাচালং নদীর পাড়) কুয়ো বানিয়ে নিয়েছিলাম আর সেই কুয়ো থেকে পানি দিয়ে আমাদের জীবন চলতো।  তবে এই সব কুয়ো ছিল শিলের কুয়ো। তাই এই পানি ছিল ঠান্ডা আর মিষ্টি। তবে এই শিলের কুয়ো বানানো এতো সহজ ছিলনা। শিল মানে পাথর ভেংগে গর্ত করে কুয়ো বানাতে হতো। এই ক্ষেত্রে বাবারা লোহার সূচালো দন্ড ব্যবহার করে গর্ত করে কুয়ো বানিয়ে ছিলেন। আমাদের সেই এলাকায় তখন মানুষ এতো কম ছিল যে নিজের পরিবার আর গ্রামের মানুষ বাদে অন্য মানুষ দেখা পাওয়া যেতোনা। আর তখন গ্রাম বলতে  বুঝায় এক একটি পাহাড়ের উপর এক একটি পরিবারের বসতি। সেটাও অনেক অনেক দূরের দূরের। মাইলের উপর মাইল শুধু ঘন বন জংগল। সেসব জংগল এতো ঘন বন যে প্রায় রোদই ঢুকতো না। আমাদের একএকটি বাড়ির চারিদিকে বনের জীবজন্তু বাঘ ভালুক হরিন সাপ ঘোরাফেরা করতো। আর ছিল হরেক রকম পাখি। এখনতো কোন পাখিই আর আমি দেখিনা। আমার এই মেয়ের বাড়িতে পাখির ডাকও শোনা যায়না। আমার মেয়ের বাসার সামনে শুধু কালো কাক দেখি আর মাঝে মাঝে ময়না পাখি। এখন আমাদের হিলে আগের সেই পাহাড়ের আর কিছুই নেই। সেসময়ে শীতকালটা ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর সময়। ঘন কুয়াশা পরার কারণে এক হাত দূরের জিনিষও দেখা যেতোনা। অনেক সময় বাড়ির কাছাকাছি কোন ঝোঁপঝাড়ে দেখা যেতো হিংস্র প্রাণী লুকিয়ে আছে। এইরকম অনেক ঘটনার কথা আমার আজো মনে আছে। মাঘ আর পৌষ মাসে এমন ঠান্ডা পরতো সেই ঠান্ডায় বাঘের গর্জন শুনা যেতো। আর সেই গর্জন শুনে আমরা ছোটরা ভয়ে কাঁটা হয়ে ভাবতাম এই বাঘ বুঝি আমাদের বাড়ির উঠোনে বসে ডাকছে।

মনে আছে আমার এখনো, হরিনা আর সাজেক এলাকায় কুকি জাতির মানুষরা বসবাস করতো। মাঝে মাঝে কুকিরা আসতো আমাদের গ্রামে আর যেহেতু আমার আজু গ্রামের কার্বারী ছিলেন তাই কার্বারী বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হতো। তারা আসতো হাতি মারতে। বাঙালীরাও আসতো চিটাগাং থেকে এখানে হাতি মারতে। কুকি আর বাঙালীরা একযোগে হাতি মারা শুরু করার পর আমাদের এলাকার হাতিরা সব পালিয়ে যায়। এই হাতি মারা অবশ্য শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ হবার আগে মানে পাকিস্তান আমলে। এখন হাতি বলো বাঘ বলো হরিণ বলো বড় বড় গাছ বন বলো কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই পাহাড়ে।

বিয়ের পরের জীবনঃ

আমার মায়ের বিয়ে হয় তের(১৩)বছর বয়সে। আর আমার বিয়ে হয় চৌদ্দ(১৪)বছর বয়সে। আমার শাশুড়ি ‍ছিলেন আমার মায়ের আপন মাসিত বোন। লারমা গোজাতে জন্ম নেয়া উনার নাম ছিল মুক্তলতা চাকমা। আমার শ্বশুরের নাম হচ্ছে নিশি চন্দ্র চাকমা। আর আমার স্বামীর নাম হচ্ছে বিজয় কুমার চাকমা। আমাদের সংসার জীবনে ছয়(৬)ছেলে-মেয়ে জন্ম নিলেও দুটো বাচ্চা মারা যায় জন্মের পরপরই। তখন এলাকায় ভালো ডাক্তার ছিলনা। গ্রামে গ্রামে অসুখ বিসুখের চিকিৎসার জন্য গ্রামের বৈদ্য আর ওজারাই ছিলেন ভরসা। সেই সাথে ছিলনা ঔষধ পত্তর। আমাদের কাছাকাছি এলাকার মধ্যে শুধু লংগদু বাজারে ডাক্তার ছিল। সেই ডাক্তার পাশ করা না হাতুড়ে ডাক্তার ছিল সেটাও আমাদের জানা ছিলনা। আমাদের বাড়িতে বা গ্রামের কারোর বড়ো ধরণের অসুখ বিসুখ হলে সেই লংগদু বাজারের ডাক্তারকে আনা হতো চিকিৎসার জন্য। তবে গ্রামের সকলের রোগ শোক চিকিৎসার  জন্য ছিল সেই বৈদ্য আর ওজারা। বাচ্চা প্রসব করানো থেকে শুরু করে মেয়েদের যাবতীয় অসুখের জন্য গ্রামের ওজারাই ছিলেন ভরসার জায়গা। আর বৈদ্য মানেইতো সব রোগের ডাক্তার। আমারতো এখনও মনে হয় এখনকার পাস করা ডাক্তারদের থেকে সেই সময় ওজা আর বৈদ্যরা চিলেন  চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক দক্ষ।

আর ছিল নানা ধরণের পূজা। এখন হাসি পাই ভাবতে যে সেসময় ছিল চোখে ‘না দেখা দেবতাদের’ জয় জয়কার (হা হা হাসি)। আমরা বন দেবতা, জল দেবতার পূজা করতাম এছাড়াও আরো অনেক নাম ভূলে যাওয়া দেবতা ছিল, সে দেবতাদের পূজা করতো গ্রামবাসীরা( হাসি)। অবশ্য আমার এখন মনে হয়  সেসময়ের মানুষজন অনেক সৎ নিয়মানুযায়ী চলাফেরা করতো বলে এতো অসুখ বিসুখ হতোনা। হয়তো নানান বিপদ আপদ অসুখ বিসুখ থেকে তারা নিজেদের কর্মের গুণে রক্ষা পেতো।

আর এখন চাকমাদের মধ্যে যে হারে ভান্তে দেখা পাওয়া যায় তখন ভান্তে বলতে আমরা বুঝতাম মগ/মারমা ভান্তে। তখনকার সময়ে প্রায় সব ভান্তেরা ছিলেন মগ/মারমা জাতি থেকে। হাক্কস্যে/হাকপোজ্যে আদামের/গ্রামের বৌদ্ধ মন্দিরের ভান্তেও ছিলেন মগ/মারমা জাতির। আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ম করে মন্দিরে চিয়ং পাঠিয়ে দিতেন মা সেটা আমার মনে আছে।

হাক্কস্যে/হাকপোজ্যে আদামটি দেখতে আমাদের আদামের চাইতে অনেক বলপিয়ে/খোলামেলা সুন্দর ছিল। খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন একটা আদাম। এখন কেমন আছে কে জানে। অনেক বছরতো আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। তাছাড়া এখন পরিস্থিতি এতো খারাপ যে কোথাও যেতে ভয় লাগে। আর হয়তো কখনো আমার সেদিকে যাওয়া হয়ে উঠবেনা। সেসময়ে আমাদের সবার বাড়ি ছিল বাঁশের তৈরী। আর যারা খুবই অবস্থাপন্ন ছিল তাদের বাড়ি ছিল মাটি দিয়ে তৈরী গুদাম ঘর। তখন আমাদের বাড়ি ছিল বাঁশের তাই আমরা বৈদ্যদের আর আমাদের নিজেদের নিয়ে রসিকতা করতাম এইভাবে সুরে সুরে “বৈদ্য ঘরর নিত্য জ্বর,খীসা কার্বারীর ভাঙ্গা ঘর”( হাসি)।

আমার শ্বশুর বাড়ি ছিল আলক ঘর মানে অনেক গুলো খুটির উপর তোলা বাড়ি। সেই বাড়িটি ছিল বেশ বড় কারণ আমার শ্বশুররা ছিলেন পাঁচ(৫)ভাই এবং সকলেই এক বাড়িতেই থাকতেন। আমার শ্বশুর দুই বার বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তিনি খুবই একজন শান্ত আর ভালো মানুষ ছিলেন। কোন কিছুতেই সহজে রাগ করতেননা । তিনিও ভূবন চাকমা নামে একজন শিক্ষককে  বাড়িতে রেখে দিয়ে ছিলেন যাতে আমরা মেয়েরা পড়াশুনা করতে পারি। প্রায় চল্লিশ(৪০) জনেরই অধিক সদস্য ছিল আমাদের এই একান্নবর্তী পরিবারে। সেই পরিবারে বিয়ে হবার পর যখন দেখলাম এতোজন মানুষের জন্য রান্নার আয়োজন চলছে তখন ভয়ে আমার মাথা ঘুরে পরে যাবার মতো অবস্থা হয়েছিল। এরপরতো রান্না করতে হবে শুনলেই আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যেতো এই ভেবে এতোজনের জন্য রান্না করতে হবে(হাসি)! আমার এখনো চোখে ভাসে আমরা পাঁচ (৫) জা’ সকালেই উঠেই রান্না করতে রান্না ঘরে ঢুকতাম। তবে রান্নার জন্য এখনকার আর তখনকারের মধ্যে একটাই র্পাথক্য যে তখন মাত্র দিনে দুইবেলা রান্না করতে হতো। এখনতো তিনবেলা রান্না করে মানুষ। তখন সকলে সকাল দশ(১০)টার মধ্যে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতো আবার সন্ধ্যা ছয়/সাত(৬/৭)টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে সবাই ঘুমাতে চলে যেতো।

 

সেই সময়ের এই সময়ের রক্তাক্ত লংগদুঃ

সেসময়কালীনও লংগদু বাজারটা ছিল খুবই জমজমাট বাজার। সেই বাজারে কয়েকজন বাংগালী ব্যবসায়ী ছিল আর চাকমারাও রাংগামাটি শহরে গিয়ে জিনিষপত্র কিনে এনে এখানে হাটবাজার বারে বিক্রি করতো। তখনও মাত্র সপ্তাহে একবার  লংগদু বাজারে বিশাল হাটবাজার বসতো। সেদিন সবাই দূর-দূরান্ত থেকে এসে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ যেগুলো গ্রামে পাওয়া যেতোনা যেমন তেল নুন/লবন চিনি সেসব কিনতে আসতো হয়তো সপ্তাহের জন্য বা একেবারে মাসের জন্য। লংগদু সেসময়েও খুবই নামকরা জায়গা ছিল সকলের কাছে এখনো লংগদু অনেক পরিচিত। কী সুন্দর জায়গা ছিল লংগদু। আমার কাছে এখনো সুন্দর মনে হয় আমার লংগদুকে। কিন্তু বারবার লংগদুতে চাকমাদের উপর হামলা হয়। আমার নিজের মেয়ের বাড়িও দুইবার পুড়ে দিয়েছে সেটেলার বাংগালীরা।

 

দাগন্যে বাংগালঃ

বছরে পাঁচ(৫) মাসের জন্য চিটাগাং থেকে যে বাংগালীরা আমাদের এলাকায় আসতো আমরা তাদেরকে “দাগন্যে বাংগালী” মানে কাজ করতে আসা বাংগালী ডাকতাম। এখন যেভাবে সেটেলার বাংগালীরা আমাদের মারতে আসে, ঘর-বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় তখন কি ভেবেছি এই বাংগালীদের এতো সাহস হবে! তো এই দাগন্যে বাংগালীদের কাজ ছিল ধান লাগানো থেকে শুরু করে ধান কেটে বাড়িতে তুলে দিয়ে পারিশ্রমিক নিয়ে তারপর নিজ বাড়িতে চলে যাওয়া। তখন দেখেছি অনেক বড় বড় নৌকায় করে একসংগে অনেক দাগন্যে বাংগাল আমাদের এলাকায় আসতে। তারা আমাদের এলাকায় তখনই আসতে পারতো যখন আমরা তাদেরকে ডাক দিতাম মানে কাজের জন্য তাদের আসতে বলতাম।

 

আমাদের সময়ের বিজু উৎসবঃ

আমাদের সময়ের বিজু উৎসব আর এখনকার বিজু উৎসব একেবারে আলাদা। যদিও এপ্রিল মাসের বার,তের,চৌদ্দ তারিখ আমাদের বিজু উৎসব আর নুয়ো বজর শুরু হতো কিন্তু এপ্রিল মাস আসার আগেই সেই বিজু উৎসবের জন্য মদ-জগরা তৈরী করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেতোত। বিশেষ করে ‘জগরা(এক ধরনে মিষ্টি জাতীয় মদ বা পানীয়’ বানাতে অনেক সময় লাগে তাই জগরা বানানোর কাজ প্রায় দুই/এক মাস আগে থেকে করতে হতো। বিজুতে তখন শুগরো গুলো/মিষ্টি কুমড়ো আর আলু দিয়ে একধরণের পিঠা বানাতাম। তাছাড়া নানা ধরণের পিঠা তৈরী করতাম সকলের জন্য। ফুল বিজুতে ফুল আর পানি তোলা ছিল একেবারে অবশ্যই করণীয় কাজ। ফুল আর পানি ছিল জল বুদ্ধকে পূজার জন্য। আর মূল বিজুর জন্য রান্না বান্নার আয়োজন এই ফুল বিজুতেই করতাম।

গজ্যা পুজ্যা বিজু বা নুয়ো বজরঃ

ছোট বেলায় দেখেছি বাবা-মা গজ্যা পুজ্যা বিজুতে বাড়িতে গ্রামের বয়স্ক মুরুব্বীদের দুপুরের ভাত খেতে নিমন্ত্রণ করতেন। আর সেদিন খুব ভালো খাওয়া দাওয়া হতো। তবে সেদিন বাড়িতে কোন প্রাণী হত্যা করা হতোনা। আমার আজু মানা করে দিয়েছিলেন। সেই রেওয়াজটা আজো আমরা পালন করে চলি। তাছাড়া সেদিন বাড়ির বাইরের কেউ কাজ করতো না। সেদিন ছিল সকলের ছুটি। কিন্তু আমাদের মেয়েদের ছুটি ছিলনা। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হতো। মেহমানদারী করা লাগতো। সেদিন আরো বেশী ব্যস্ত থাকতাম আমরা।

 

 

 

সেকালের পিনন-খাদিঃ

আমার মায়ের পিননের চাবুগী ছিল অনেক বড়ো বড়ো। প্রায় হাতের এক মুঠো সমান। মা বিয়ের আগে বেইন বুনতে পারলেও পিনন-খাদি বুনতে পারতোনা। বিয়ের পর তার শাশুড়ি  থেকে পিনন-খাদির সাথে চাবুগী বোনা শিখেছিলেন। গ্রামের নারীদের মধ্যে কার চাবুগী বোনা কতো বেশী সুন্দর সেই নিয়ে মজার প্রতিযোগীতা হতো। এখনকার মতো রং-বেরঙের পিনন-খাদি তখন ছিলনা। শুধু কালো,নীল আর লাল সুতা মিশ্রনের পিনন-খাদি ছিল। তাছাড়া সুতো পাওয়াও যেতোনা তেমন। সরকার সুতোর জন্য রেশনের মতো নিয়ম করে দিয়ে ছিল। মাত্র এক(১)সের সুতো কিনতে পারতো প্রত্যেক পরিবার। পরে সে সুতোতে হতোনা দেখে মা নানুরা নিজেরা তুলো কেটে সুতা কাটতেন। আমরা তখন ছোট ছিলাম তাই বুঝতাম না যে সুতো বিক্রিতে সরকার কন্ট্রোল করছে। বড়ো হবার পর যখন নিজে পিনন বোনা শুরু করলাম তখন বুঝেছি।

আমার বিয়েতে আমি শাড়ি পরেছিলাম। এবং কয়েকটা শাড়িও সাথে করে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে পরবো বলে। কিন্তু আমার শ্বশুর শাড়ি পরা একেবারে পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন এটি বাংগালীদের ড্রেস। তাই এই শাড়ি আমার বাড়িতে পরতে পারবেনা। এরপর থেকে শ্বশুর বাড়িতে আমার আর শাড়ি পরা হয়নি। বিয়ের আগে আমি পিনন-খাদি বুনতে শিখিনি। তবে অন্যান্য মেয়েদের মতো আমাকেরও বুরগী(কম্বল), হাত কাপড়,গামছা এইসব কিভাবে বুনতে হয় তা শিখে নিতে হয়েছে। আমাদের সমাজে বুনতে পারা মেয়েদের অনেক সন্মান । কিন্তু সেসব বুনতে জানলে কি হবে আসল জিনিষ মানে পিনন-খাদিতো আর বুনা শিখিনি। সেই পিনন-খাদি বুনতে শিখেছিলাম আমার শাশুরির কাছে।

ছোটবেলায় আমরা ছোটরা শুধু পিনন পরতাম। তখন খাদি পরার জন্য একটা নির্দিষ্ট বয়স লাগে। পিরিয়ড হবার আগে মেয়েরা খাদি পরতে পারতোনা। পিরিয়ড হবার পর মেয়েদের বেজোড় বয়সে বুকে ফুল খাদি পরানো হতো। তখন এটা নিয়মের মতো ছিল। জোড় বয়সে খাদি পরালে নাকি অমংগল হয় তাই বেজোড় বয়সেই পরাতে হতো। তখনতো সবাই খাদিকে বলতো ‘ফুল খাদি‘। মেয়েরা বড় হয়েই উঠলেই তারপর ফুল-খাদি পরানো হতো হাল-পালনির সময়। আমার মনে আছে সাধারনতঃ এগারো/বার(১১/১২) বছর বয়সী মেয়েকে জোর করে আহল-পালনির  সময় ফুল-খাদি পিননের সাথে পরানো হতো। তো এক আহল-পালনির দিনে আমার পেজেঙারা/পিসীরা আমাকে একপ্রকার জোর করে ফুল-খাদি বুকে বেঁধে দিয়েছিল। আমি লজ্জায় সংগে সংগে সেই খাদি বালিশের নীচে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। ফুল-খাদি পরানোর মানে হচ্ছে মেয়েটি এখন বিবাহযোগ্য। আমার সাথে আমার দুই জেঠাতো বোনদেরও ফুল-খাদি পরানো হয়েছিল। তোমরা এখন বড় হয়ে গেছো এই কথাটা আমাদেরকে খুবই লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল(হাসি)। এখন এইসবের কোন বালাই নেই। আমাদের সময়ের সেই নিয়ম গুলো এখন আমার কাছে একধরণের ‘হিরিং হারাং(ঢং)’ মনে হয়। এখনতো দেখি  সবাই ছোট্ট মেয়েদের কী সুন্দর সুন্দর পিনন-খাদি পরাচ্ছে। দেখতে ভালোই লাগে। আমাদের সময়ের চাইতে এখন মেয়েরা অনেক স্বাধিন বলতেই হবে।

বিয়ের অনুষ্ঠান/মেলা অনুষ্ঠানঃ

আমাদের সময়ে চুঙুলাং/চুমুলাঙ এর সময় সবাইকে তখন শুকুরের মাথা প্রণাম করতে হতো। আমার বিয়ের সময় যখন আমাকে সেই কাটা শুকুরের মাথাকে প্রণাম করতে বললো আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো বয়স কম ছিল আর বিয়েতে আমার ইচ্ছে ছিলনা সে কারণে হয়তো আরো বেশী ভয় পেয়েছিলাম। পরে সেই শুকুরের মাথাটা প্রণাম করতে কেউ আর আমাকে জোর করেনি। আমার বিয়েতে শ্বশুর বাড়ি থেকে সারা শরীর জুড়ে রুপার গয়না দিয়েছিল। সোনা দিয়ে বানানো হয়েছিল শুধু কানের দুল। তখন টেঙত হাড়ু/পায়ের খাড়ু জোড়া ছিল তখনকার সময়ে বিশ( ২০) টাকা করে। আর হজেই /কজেই হাড়ুর দাম ছিল চল্লিশ( ৪০) টাকা করে। আগেই বলেছি আমার বিয়ে যখন ঠিক করা হয়েছিল তখন আমি মামুর বাড়ি হরিনাতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে মামুর কাছে খবর পাঠানো হলো আমার মায়ের সন্তান হবে তাই যেন আমি বাড়িতে ফিরে আসি। কিন্তু বাড়িতে ফেরার পর দেখি আমার বিয়ের আয়োজন চলছে। যদি জানতাম আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তাহলে আমি বাড়িতে আসতাম না। বাড়িতে ফিরে বিয়ের কথা জানার পর আমি বিয়ে করবো না বলে গো ধরে কাদঁতে বসেছিলাম।  মনে হয় কয়েকদিন নাওয়া খাওয়াও বাদ দিয়েছিলাম( হাসি)। আর রান্না ঘরের চুলো পা দিয়ে লাথি মেরে ভেঙ্গে দিয়েছিলাম সেটা মনে আছে(হাসি)।

তবে আমার বিয়ে অনেক ধুমধাম করে হয়েছিল। সারারাত ”ডোলি তামাজা/ যাত্রা পালা” মানে নাটক গান অনুষ্ঠান চলেছিল। শুকুরের মাংশ দিয়ে মেহমানদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। আমার শাশুড়ী খুব র্ধামিক ছিলেন।  বিয়ের দুই বছর পর আমার প্রথম সন্তান হয়।

কাপ্তাই বাঁধের পানিঃ ঝর-নাল, হাক্কস্যে দোর থেকে লংগদু তিনটিলাঃ

যে বছর চাকমারা ‘বর –পরং’ এ যাচ্ছে সে বছর আমার মেজো মেয়েটির(মোনপুদি মা’র) জন্ম হয়। বাঁধের পানি আসার পর পরই লংগদু তিনটিলাতে আমরা চলে আসি। অবশ্য তার অনেক আগে আমরা এই লংগদু তিনটিলাতে বাড়ি করেছিলাম। কারন যখন কাপ্তাই বাঁধ বানানো হবে আর কোন কোন এলাকা পানিতে ডুবে যাবে তাই নিয়ে গ্রামে গ্রামে জরিপ করা হয়েছিল। আমাদের গ্রামটাও ডুবে যাবে  বাঁধের পানিতে  বলে জানানো হলে আমার শ্বশুর আর স্বামী মিলে লংগদু তিনটিলাতে জায়গা নিয়ে বাড়ি বানিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এতসব পরেও সবার মনে এক ধরণের অবিশ্বাস কাজ করেছিল তখন যে সত্যি সত্যি পানি এতদূর আসবে? সত্যি সত্যি আমাদের গ্রাম ডুবে যাবে! এই বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচালে আমরা লংগদু তিনটিলার পাহাড়ে উচুঁ জায়গায় নতুন ঘর করলেও রয়ে গিয়েছিলাম পুরোনো গ্রামে। যদি পানি না আসাটা সত্যি হয়। কিন্তু একদিন সত্যি সত্যি গ্রামে পানি আসলো তখনই বাধ্য হলাম পুরাতন গ্রাম ছেড়ে নতুন গ্রামে আসতে। পুরাতন গ্রাম হাক্কস্যে দোর থেকে লংগদু তিনটিলা। তখন আয়ুন/আশ্বিন মাস। ধান চাল সব ক্ষেত থেকে বাড়িতে উঠানো হয়ে গেছে। ‍সবাই জানে এবং নিজেরাই বলাবলি করছে যে এইবার কাপ্তাই বাঁধের পানি আসবে তারপরও সবাই গ্রামে রয়ে গেছে একধরণের জেদ নিয়ে। সবাই র্প্রাথনা করছে যেন শুনা কথা সত্যি না হয়, বাঁধের পানি যেন না আসে গ্রাম যেন ডুবে না যায়।  আমার এখনো চোখে ভাসে ধীরে ধীরে পানি আসছে, বাড়ছে আর ধান্য জমি বড় বড় গাছ ডুবে যাচ্ছে, বাড়িতে পানি ঢুকলো বলে। সত্যি সত্যি পানি যখন সব ডুবাতে শুরু করলো তখন তাড়াহুড়ো করে সবকিছু নিয়ে নৌকায় উঠলাম সবাই। অবশ্য আগে থেকে বড় বড় তিনটি নৌকা ঠিক করা ছিল। একদিকে পানি বাড়ছে আরেকদিকে আমরা যেভাবে পারি বাড়ির জিনিষপত্র নৌকায় তুলার চেষ্ঠা করছি। সেটা এক ধরণে করুণ দৃশ্য। সবাই ব্যস্ত নিজেদের আর বাড়ির জিনিষপত্র বাঁচাতে। আমি বেশ শক্ত সার্মথ্যবান ছিলাম তখন। ধান চালের দেড় মনের বস্তা পিঠে নিয়ে নৌকায় তুলেছি। কিন্তু শতচেষ্টা করলেও কি এক বাড়ির সবকিছু সাথে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আনা যায়! আনা যায় না। কতো টুকরো টুকরো স্মৃতির জিনিষপত্র সব পানির নীচে চলে গেলো চোখের সামনেই। আমাদের র্পূব পুরুষের শশ্মান পানির তলে ডুবে গেলো একেবারে। আরো কত কিছু  রয়ে গেছে। কত স্মৃতি, ঘর-দোর, বাগান বাগিচা, গাছ-পালা সবতো রেখে আসতে হলো।

যদিও নতুন গ্রাম তিনটিলা আদাম পুরাতন গ্রাম থেকে অনেক বড় সুন্দর আর খোলামেলা ছিল। তারপরেও সেই গ্রামের স্মৃতি কী ভূলা যায় বলো! লংগদু তখনও অনেক জমজমাট এলাকা ছিল। লংগদু বাজারেই থানা ছোট্ট ডাক্তার খানা বাজার সবই ছিল। তবুও সেই হাক্কস্যে দোরের গ্রামের জন্য আমাদের মন আজো উদাস হয়।

আমাদের হাক্কস্যে দোর গ্রাম থেকে অনেকে মেইনী মানে দিঘীনালা এলাকায় বসতি করতে চলে গেছে। আর কয়েক পরিবার গেছে চেঙেই মানে বর্তমানে খাগড়াছড়ির দিকে।

কিন্তু যারা তিনটিলা আদামে বসতি করেছিলাম তাদের বেশীর ভাগ ভারত সরকারের মাগানা ভাত খাওয়ার জন্য সেই ভারতে “বর-পরং” চলে যাওয়ার মনস্থির করে। সেসময়ে দেখেছি একসাথে রাতের বেলা গ্রামকে গ্রাম ভারতে চলে যাচ্ছে।

যারা এই গ্রামবাসীদের “বর-পরং”এ নিয়ে যাচ্ছে তারা গ্রামে গ্রামে রটে দিয়েছিল যে ভারত সরকার তাদের জন্য সবকিছু ব্যবস্থা করে রেখে দিয়েছে। আর  ভারত সরকার যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে মাটির নীচ দিয়ে গাড়ি চলাচল করে। একদিন একরাত নাকি শুধু গাড়িতে করে যেতে হয়। কত কিছুযে তখন মানুষের মুখে মুখে রটে গিয়েছিল। বলা হয়েছিল ভারতে গেলেই সব পাওয়া যাবে থাকার কৃষি কাজের জায়গা জমি। কোন অভাব থাকবেনা। আর ভারত সরকার আরামে বসে বসে খাওয়াবে। এরই ভিতর একদিন আমাদের বাড়িতেও কথা উঠল বর-পরং যাওয়া নিয়ে। আমার তখন মাত্র আরেকটি মেয়ের জন্ম হয়েছে। এই সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাবো? একদিন আমি আমার স্বামীকে জীজ্ঞেস করলাম বলোতো এরা যাচ্ছে কোথায়? এরই মধ্যে বর-পরং যাওয়ার পথে অনেক বুড়ো মানুষজন মারা যাচ্ছে সেসব খবরও দেরীতে হলেও আমাদের কানে আসতে লাগল।

কাপ্তাই বাঁধঃ মেজো বোন বন দেবী চাকমার হারিয়ে যাওয়াঃ

কিন্তু আমি আমার পরিবারের বর-পরং যাওয়া ঠেকাতে পারলেও আমার ছোট বোনের ‘বর-পরং’ যাওয়া ঠেকাতে পারিনি। সেসময়ে আমার সেই বোনের পরিবার, আমার কাকা, আমার দেবর এবং কাকা শ্বশুর এর পরিবার বর-পরং এ চলে যান। আমাদের পরিবারের এক বিশাল অংশ সেই যে দেশ ছেড়ে গেছে বর-পরং এর নামে এরপর আর তাদের সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ করার সুযোগ ঘটেনি। শুধু একবারই খবর এসেছিল আমার বোনের স্বামী মারা গেছে নেফাতে। তখন শুধু আমরা জেনেছিলাম তারা নেফাতে মানে অরুনাচলে বসতি গড়েছে।

আমার মেজো বোন যে আমার চার/পাঁচ( ৪/৫) বছরের ছোট, নাম চিত্তি, ভালো নাম বনদেবী চাকমা। আমার এই বোনটি দেখতে খুব সুন্দর লাল টুকটুকে ফর্সা ছিল। আমার মায়ের গায়ের রং সে পেয়েছিল। দেখতে কী সুন্দর ছিল চিত্তি। তার স্বামীর পরিবার ছিল বড়বো হোজার বংশধর, টিদেই রেগা গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। আমাদের গ্রাম থেকে তাদের গ্রাম বেশ দূরে। একদিন আমার ভাই দুরছড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে এসে বললো যে আমরা সবাই যেনো বর-পরং এ চলে যায়। তার প্রস্তাব শুনার পরপরই আমি এক বাক্যে বলে দিয়েছিলাম আমরা যাবোনা। কিন্তু আমার শ্বশুর মনে মনে ঠিক করেছিলেন বর-পরং যাবার। আমার ভাইয়ের প্রস্তাব পেয়ে আমার স্বামীও এক পায়ে খাড়া হয়ে গেলো বর-পরং এ চলে যাবার। আমি দৃঢ় ভাবে বললাম যাও তোমরা। মরলে আমি এইখানে মরবো, বাঁচলে এখানেই বাঁচবো আমি আমার গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিনা। আমি এই গ্রামে একাই আমার সন্তানদের নিয়ে থাকবো। আমার এমন সিদ্ধান্ত শুনে আমার ছোট ভাই আর কিছু না বলে নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে বললো ‘বেবেই কোথাও যাবেনা/দিদি কোথাও যাবেনা”। কিন্তু আমার সেই ছোট ভাইয়েরও বর-পরং এ আর যাওয়া হলোনা কারণ সেই রাতে তার আরেকটা সন্তান জন্ম নিয়েছিল যার ফলে তার যাওয়ার পরিকল্পনা উলট পালট হয়ে গিয়েছিল। কাপ্তাই বাঁধের পানি আসার পর এই বর-পরং যাওয়া আমাদেরকে একেবারে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। কী এক সময় গিয়েছিল তখন। সবার মধ্যে আর কোন প্রসংগ নেই । শুধু দেশ ছাড়ার কথা বর-পরং যাবার কথা। কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে, কি খাবে এসবের কোন চিন্তা নেই। দেশ ত্যাগ করতে হবে সেটাই একমাত্র লক্ষ্য ছিল তখন।

আমার কাকার নাম মুধুরো মোহন চাকমা ওরফে প্রমত্তে বাপ। আমরাতো বংশা গোজা ফেমা গোষ্ঠীর বংশধর। সেইযে এরা বর-পরং  গেলো কোথায় গেলো, কোথায় আছে, কেমন আছে, বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে আর কিছুই জানা হলোনা আমাদের। আমার মন সারাক্ষণ আমার বোনের জন্য হাহাকার করে। এখনকার মতো তখনতো এতো সুযোগ সুবিধা ছিলনা ভারতে যাবার। আমার যদি বয়স থাকতো তাহলে হয়তো একবার নেফাতে গিয়ে বোনের খোঁজ নিতে চেষ্টা করতাম। তাই বোনের খোঁজ পাওয়ার জন্য আমি নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে ছিলাম।

তখন বন ভান্তের(বৌদ্ধ ধর্মের পুজনীয় ধর্মীয় গুরু) পরি-নির্বাণ হয়নি, একদিন রাংগামাটিতে খবর পেলাম অরুনাচল থেকে অনেক চাকমা এসেছে বনভান্তেকে পুজা দিতে। সেই কথা শুনেই আমি আমার নাতনি সুজাতাকে নিয়ে বন ভান্তের মন্দিরে গিয়ে হাজির হলাম। আর সবার মুখ দেখে দেখে খুঁজতে লাগলাম আমার বোন বন দেবীর চেহারার সাথে কারোর মিল আছে কিনা। না সে আসেনি। অরুনাচল থেকে আসা মানুষদের মুখ দেখছিলাম আর জীজ্ঞেস করছিলাম তার বন দেবী চাকমা নামে কাউকে চিনে কিনা। তখন হাহাকার ভরা এক উত্তেজনায় পেয়ে বসেছিল। চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। কিন্তু তারাও আমার সেই বোনের কোন খোঁজ দিতে পারেনি। সেদিন সারাদিন খুব ভিষন্ন কেটেছিল। আমি দুঃখে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। এতো জন অরুনাচল থেকে আসলো কেউ আমার বোনের খবর দিতে পারলোনা, এইটা মেনে নিতে আমার কষ্ট হয়েছিল ভিষন।  যেই রাত্রে আমার বোনকে স্বপ্নে দেখি সেদিন সারাটাদিন শরীর মন সবকিছু ক্লান্ত থাকে। আমার কিছুই ভালো লাগেনা তখন। আহা আমার সেই বোনের খোঁজ একবার যদি পাওয়া যেতো! শুধু একবার। কোথায় আছে, কেমন আছে, বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে। একবার যদি জানতে পারতাম!

মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়েঃ

আমার এখন যে বয়স, যেকোন সময় মরণ আসতে পারে। সারাটাদিন একা থাকি এই মেয়ের বাড়িতে আর পুরনো দিনের কত কিছু মনে পড়ে। জীবনে কত কিছু ঘটে গেলো। কতবার গ্রাম, বাড়ি,সংসার বদলাতে হলো। আমার আরেক মেয়ের বাড়ি এখন লংগদুতে। তার জন্ম শুক্রবারে তাই পঞ্জিকা দেখে নাম রাখা হয়েছিল শুভংগলতা চাকমা। কারণ শুক্রবারে জন্ম নেয়া নাকি শুভ লক্ষণ। কিন্তু এই মেয়েটিই বার বার বিপদে পড়ে। এরই মধ্যে তার বাড়ি দুই তিনবার পুড়ে গেছে সেই লংগদুতে। সেটেলার বাংগালী আর্মিরা মিলেই তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। এতো দু:খের মধ্যেও ভাবি হয়তো এটি আমাদের কর্মফল। দিন যায় সময় যায় আর এই দু:খের সংসারে আমরা কর্মফল ভোগ করতে থাকি(দীর্ঘশ্বাস)। আমার সেই বোনের খবর যদি একটু পাওয়া যেতো তাহলে হয়তো একটু দুঃখ কমতো। তুমি কি একটু চেষ্টা করবে আমার বর-পরং এ গিয়ে হারিয়ে যাওয়া বোনের খোঁজ পাওয়ার!!



Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ, যাপিত জীবন

Tags: , , , , , , , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: