“ত্রাণের কোন সংকট না থাকা” দেশে, “মানুষের ঘরে খাবার নেই এমন রিপোর্ট না পাওয়ার” দেশে তবে কি এগুলো “লোক ভাড়া করে করানো বিক্ষোভ”?

অনলাইনে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টসমূহ একত্রিত করে নিচের ৬৪ জেলায় ত্রাণ বিষয়ক বিক্ষোভ-প্রতিবাদ-অভিযোগের এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

মূল প্রতিবেদনে যাওয়ার আগে দেশের দুইজন মন্ত্রী ও দেশের প্রধানমন্ত্রীর চারটি বক্তব্য দেখা যাক।

১ এপ্রিল ২০২০:

“দেশে ত্রাণের কোন সংকট নেই” – ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী

দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, “গত ২৪ মার্চ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এবং জেলা প্রশাসকদের সাথে মতবিনিময় করে তাদের চাহিদা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সারা দেশে ৩৯ হাজার চারশত মেট্রিক টন চাউল ও বারো কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সব জায়গায় পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌছানোর পরও পর্যান্ত খাদ্যসামগ্রী মজুদও রয়েছে। এজন্য আমরা বলতে পারি দেশে ত্রানের কোন সংকট নেই।” (ইত্তেফাক, ১ এপ্রিল ২০২০)

১১ এপ্রিল ২০২০:

“এখন পর্যন্ত দেশের কোথাও এমন কোন রিপোর্ট পাইনি যে,
কারও ঘরে খাদ্য নেই।” – ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী

জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানান, দেশব্যাপী দরিদ্র এমনকি মধ্যবিত্তদের ঘরেও খাবার ও আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছে সরকার। আগামী তিন মাস পর্যন্ত এভাবে খাদ্যসহায়তা দেয়ার সক্ষমতা সরকারের রয়েছে। তিনি বলেন, ছুটি ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত ছয়দিন খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এটা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত সারাদেশে ৬৫ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন চাল এবং ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং শিশুখাদ্যের জন্য তিন কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে নিম্নআয়, কর্মহীন এমনকি মধ্যবিত্তদের মাঝেও তা বিতরণ করা হচ্ছে। ডা. এনাম বলেন, দেশে খাদ্যসংকট যে আসতে পারে ছুটি ঘোষণার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটি বিবেচনা করেছিলেন। করণীয় নির্ধারণে তিনি সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি বলেন, দেশের যেসব মানুষ দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল তারা কর্মহীন হয়ে যাবে। তাই তাদের খাদ্য এবং অন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের নিশ্চয়তা দিতে হবে। একজন মানুষও যেন না খেয়ে থাকে না- তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারেই সবকিছু চলছে।…তিনি বলেন, আমরা জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে সবসময় খোঁজ-খবর নিচ্ছি বরাদ্দের কত অংশ কোথায় কীভাবে বণ্টন হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশের কোথাও এমন কোনো রিপোর্ট পাইনি যে, কারও ঘরে খাদ্য নেই। (জাগো নিউজ, ১১ এপ্রিল ২০২০)

১৭ এপ্রিল ২০২০:

“ত্রাণের জন্য লোক ভাড়া করে
বিক্ষোভ করানো হচ্ছে” – তথ্যমন্ত্রী

শুক্রবার (১৭ এপ্রিল) রাজধানীর মিন্টু রোডে সরকারি বাসভবনে সমসাময়িক বিষয়ে বক্তব্য রাখার সময় তথ্যমন্ত্রী  ড. হাছান মাহমুদ বলেন, “আপনারা দেখেছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ত্রাণের জন্যে বিক্ষোভ হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু সরকারের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে, এই বিক্ষোভগুলোর অনেকগুলোর পিছনে রাজনৈতিক ইন্ধন ছিল। লোক ভাড়া করে এনে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করানো হচ্ছে।” (সময়নিউজ, ১৭ এপ্রিল ২০২০)

 ২০ এপ্রিল ২০২০:

“তো যেই টাকা পাবে সেই, বা রিলিফ পাবে,
আর কাজ করবে না, বসে যাবে।” – প্রধানমন্ত্রী

এদিন কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সাথে ভিডিও কনফারেন্স চলার সময় কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান যখন ওএমএসের চাল বিক্রির সময় আরো ১৫ দিন বাড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তর দেয়ার সময় এক পর্যায়ে বলেন, “এখানে একটা কথা হচ্ছে যে আমরা তো শ্রমিক এনে দিচ্ছি, ওএমএস যেটা আমরা ১০ টাকায় দিচ্ছি ওটা তো চালু আছে, তাছাড়া অতিরিক্ত যেটা আমরা ১০ টাকায় আরো ৫০ লক্ষ দেবার কথা আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন আছে যে এমননিতেই আপনারা শ্রমিক পান না ধান কাটার। এখন যদি রিলিফ আবার বেশি দেয়া হয় তাহলে ওই রিলিফ পাওয়ার পরে কি তারা মাঠে যাবে? ধান কাটবে? বা কাজ করবে? তখন তো আবার আপনি শ্রমিক পাবেন না। সেইটাও আবার একটু বিবেচনায় রাখবেন — এটা আমি বলবো। এটাও একটু লক্ষ্য রাইখেন। … আমাদের দেশের মানুষ একবেলা পেট ভরে খেতে পারলে পরেরবার আর চিন্তা করে না। তো যেই টাকা পাবে সেই, বা রিলিফ পাবে, আর কাজ কাজ করবে না, বসে যাবে। ওই জিনিসটাও একটু দেখতে হবে।”

(তথ্যসূত্র: ইউটিউব থেকে নেয়া ২০ এপ্রিল করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ জেলা এবং ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাসমূহের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্স, লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=ac03Be2NXlM ১ ঘন্টা ১২ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড থেকে দেখুন)

এবারে মূল প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ দেখা যাক।

মাত্র ৫দিন অনলাইনে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় পত্রিকাগুলোর ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করে যেসব খবর পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইসের প্রাদুর্ভাবের ফলে দেশে সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পর গত ২৯ মার্চ ২০২০ থেকে ২৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত এই এক মাসে সারাদেশের ৪৩ টি জেলায় সর্বমোট ১৪৮ বার ত্রাণ দেয়ার দাবিতে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়াও গত এক মাসে সারাদেশের মোট ৪১ টি জেলায় সর্বমোট ৫৭ বার ত্রাণ নিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ/ বিক্ষোভ/সাংবাদিকদের কাছে ত্রাণের দাবী বা অভিযোগ করার সংবাদ পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে ৬৪ জেলার প্রতিটিতেই হয় সরাসরি ত্রাণের দাবীতে বিক্ষোভ নয়তো ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম নিয়ে বিক্ষোভ নয়তো অনিয়মের অভিযোগ কিংবা বিক্ষোভ ছাড়া সাংবাদিকদের কাছে ত্রাণ দাবী করার খবর পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য বিক্ষোভ প্রতিবাদ বা অভিযোগের প্রকৃত সংখ্যা এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত সংখ্যার থেকে আরো অনেক বেশি হওয়ার কথা। তার কারণ প্রথমত সব খবর পত্রিকায় আসে না এবং দ্বিতীয়ত, এখানে মাত্র ৫ দিন অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটি করে সামনে যেগুলো পড়েছে শুধু সেগুলোকেই আনা গেছে। সকল জাতীয় দৈনিক ও সকল জেলার স্থানীয় পত্রিকাসমূহ ঘাঁটাঘাঁটি করা সম্ভব হয়নি। একারণে এই ৫ দিন ঘাঁটাঘাঁটি করেই একমাসে ৬৪ জেলায় ত্রাণ বিষয়ক বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, অভিযোগের খবর পাওয়া থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে প্রকৃত পরিস্থিতি আরো কতটা ভয়াবহ।

ত্রাণের দাবীতে বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে যে ৪৩টি জেলায়

বিভিন্ন পত্রিকার খবর অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ত্রাণের দাবীতে গত একমাসে সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ হয়েছে সেযব জেলায় সেগুলো হচ্ছে: যশোর (১২টি), ঢাকা (১১টি), চট্টগ্রাম (৯টি), রংপুর (৮টি), নীলফামারি (৭টি), গাইবান্ধা (৭টি), পাবনা (৬টি), রাজশাহী (৬টি), লালমনিরহাট (৫টি), সিরাজগঞ্জ (৫টি), জামালপুর (৪টি), পঞ্চগড় (৪টি), দিনাজপুর (৪টি), ঠাকুরগাঁও (৪টি) এবং বরিশাল (৪টি) জেলায়। এখানে ব্র্যাকেটে যে বিক্ষোভের সংখ্যাটি দেয়া আছে সেটি হল অন্তত হিসেব। কারণ এটা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করা। যেসব ত্রাণের দাবীতে করা বিক্ষোভ নিয়ে কোন প্রতিবেদন হয়নি সেগুলো এই হিসেব এর মধ্যে নেই। তাছাড়া সকল পত্রিকা দেখাও সম্ভব হয়নি। অনলাইনে জেলার নাম দিয়ে সার্চ করে তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া খবরগুলোর ভিত্তিতেই এই বিক্ষোভের সংখ্যা পাওয়া গেছে।

এই জেলাগুলো ছাড়া গত এক মাসে ত্রাণের দাবীতে অন্তত ৩ বার বিক্ষোভ হয়েছে যেসব জেলায় সেই জেলাগুলো হচ্ছে: মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়া।

ত্রাণের দাবীতে অন্তত ২ বার বিক্ষোভে হয়েছে: নরসিংদি, গোপালগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, খুলনা ও গাজীপুর জেলায়।

ত্রাণের দাবীতে অন্তত ১ বার বিক্ষোভ হয়েছে: গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, শেরপুর, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নোয়াখালি, কক্সবাজার, নাটোর, জয়পুরহাট, মাগুড়া ও ঝিনাইদহে।

ত্রাণ নিয়ে অনিয়মের প্রতিবাদে বিক্ষোভ/ প্রতিবাদ/ অভিযোগ জানানোর খবর পাওয়া গেছে যে ৪১টি জেলায়

অন্তত ৩ বার করে ত্রাণ নিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ/প্রতিবাদ/অভিযোগ জানানো হয়েছে এমন জেলাগুলো হল: নোয়াখালি, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি।

অন্তত ২ বার করে ত্রাণ নিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ/প্রতিবাদ/অভিযোগ জানানো হয়েছে এমন জেলাগুলো হল: ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি, রাজশাহী, কুষ্টিয়া,

অন্তত ১ বার করে ত্রাণ নিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ/প্রতিবাদ/অভিযোগ জানানো হয়েছে এমন জেলাগুলো হল: শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, রাজবাড়ী, শেরপুর, সুনামগঞ্জ, ফেনী, চাঁদপুর, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, ঠাকুরগাঁও, পাবনা, বগুড়া, নাটোর, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগা, মেহেরপুর, নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি, ভোলা ও পিরোজপুর।

এই বিষয়ে জেলাওয়ারি ত্রাণ বিষয়ক বিক্ষোভের বিস্তারিত টাইমলাইন (মূল প্রতিবেদন) দেখতে নিচের লিংকটিতে ক্লিক করুন ।

ক্ষুধা লকডাউনের টাইমলাইন_৬৪ জেলায় ত্রাণ বিষয়ক বিক্ষোভ প্রতিবাদ অভিযোগ

2 responses to “ক্ষুধা লকডাউনের টাইমলাইন: একমাসে ৬৪ জেলায় ত্রাণ নিয়ে বিক্ষোভ অভিযোগ”

  1. […] Social unrest and protests against corruption in welfare distribution (Mar 28 – Apr 28, 2020). Courtesy of Thotkata […]

  2. […] Social unrest and protests against corruption in welfare distribution (Mar 28 – Apr 28, 2020). Collected and mapped by Thotkata […]

Leave a reply to Why Local Context Matters in “Solving” Pandemics Cancel reply

Trending