meye shangbadik উম্মে রায়হানা, অতিথি ব্লগার*

ছোটবেলায় একবার রিকশা করে কলেজে বা স্যরের বাসায় যাচ্ছিলাম। এক রিকশাওয়ালা আমাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, সাইড দেওয়া নিয়ে আরেক রিকশাওয়ালার সঙ্গে তাঁর ঝগড়া বেঁধে গেল। ওই রিকশাওয়ালা এক পর্যায়ে আমার রিকশাওয়ালার মা কে ধর্ষণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমার রিকশাওয়ালা অস্বাভাবিক ক্ষেপে গিয়ে মারতে উদ্যত হলে রাস্তার অন্যান্য লোকের সাহায্যে ঝগড়া মিটল। চলে যাবার সময় তিনি অন্যান্যদের এই বলে নালিশ জানাছিলেন – আমার গাড়িত মহিলা, আমারে কয়, তর মায়েরে— মুহূর্তে আমি কৃতজ্ঞতায় আক্রান্ত হলাম, সেই কৃতজ্ঞতা এখনও আছে ।কারণ, তিনি ব্যক্তিগত পৌরুষাভিমান থেকে নিজের মায়ের অসম্মানে নয়, বরং নারীর প্রতি অসম্মানে বিচলিত হয়েছেন।

বলা বাহুল্য, এই সম্মানবোধ অবিমিশ্র নয়। এতে শ্রেণী প্রশ্ন ঝিলিক দেয় মনে। এই রিকশাওয়ালা কি তাঁর নিজ শ্রেণীর নারীদের প্রতিও এতটাই সশ্রদ্ধ? নারীকে সম্মান করা কি একটি পাতি মধ্যবিত্ত ব্যপার নয়? ঝিলিক দেয় ইসাবেলার স্পিচ – এইন’ট আই এ ওমেন ?  এইন’ট আই এ ওমেন? – আমার প্রায়ই মনে পড়ে। সেদিন আবারও মনে পড়ল ।

বন্ধু উদিসা ইসলাম তাঁর একটি লেখায় নিজের পরিচয় দিয়েছেন এই বলে যে তিনি একজন নারী যিনি গত নয় বছর ধরে সাংবাদিক হবার চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছেন।  তাঁর এহেন পরিচয় দানে ক্ষোভ আছে- এইন’ট আই এ জারনালিস্ট? তাহলে ‘নারী সাংবাদিক’ বলে লেবেল সাটার মানে কি? কেবল নারী বলেই ওরা মারল আর আমরাও নারী বলেই তকমা এঁটে দিলাম। ওদের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকেই কি আমরা পুনরুৎপাদন করলাম না ?  উদিসার সঙ্গে এক্ষেত্রে আমি প্রায় একমত ।প্রায় বললাম এজন্য যে, আমিও তাঁর মতই, নারী লেখক, নারী সাংবাদিক, নারী অমুক নারী তমুক বলে লেবেল সাটার বিপক্ষে।

একজন মানুষের কাজ গুরুত্বপূর্ণ , তাঁর লৈঙ্গিক পরিচয় নয়।  কিন্তু আমার আর একটা কথাও আছে। গণমাধ্যম গুলো নারী সাংবাদিক বলে নাদিয়া শারমিনকে ফোকাস করছেন এর আরেকটা দিকও আছে। সব পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছেপেছে যে গার্মেন্টসকর্মীরা কাজে গেছেন সাম্প্রদায়িক দলের ডাকা হরতাল না মেনে। তাঁরা বলেছেন – হুজুররা তো আর খাওয়াইতেন না। নারী গার্মেন্টসকর্মীরা বিভিন্ন কারণেই গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু আমরা তাঁদের কোট করছি, হয়তো প্রথমবারের মতই, তাঁরা কর্মী বলে কেবল নয়, নারী বলেও । কারণ যে আঘাত আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা আসলে, অনেক বড় শিকার হবে নারীই।

সম্প্রতি কয়েকজন পুরুষবন্ধু আমার ভ্রুক্ষেপহীন চালচলন সামলাতে বলেছেন। আমি তাঁদের সবাইকেই বলেছি যে আমি বর্তমান সাম্প্রদিকতার উত্থানে কোন রকম ভাবেই ‘বেশী’ নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছি না। যে নিরাপত্তাহীনতার কথা ওরা বলছে সেটার মধ্যে আমি সবসময়ই থাকি। এবং সেটা নারী বলেই।

আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেন- আচ্ছা আপনারা এত্ত অধিকারের কথা বলেন এই যে মহিলা, শিশু সিট- এটাতে আপনাদের অপমান হয় না ? আমি বলি- আমাকে বা আমার মত সুবিধাভোগীদের দিয়ে বাংলাদেশের মেয়েদের গুনলে তো হবে না। আমি জিন্স পড়ে রাস্তায় হাঁটতে পারি,পকেটে টাকা না থাকলেও ঢাকা শহর চষে বেড়াতে পারি, দৌড়ে বাসে উঠতে পারি, রাত করে বাড়ি ফিরতে পারি। অন্য সবাই এই সুবিধা পায় নাই। তাঁদের অনেকেরই বোরখা পরতে হয়। তাঁরা অনেকেই রাতে ফিরতে ভয় পান। তাঁরা অনেকেই বাথরুমে যাবার প্রয়োজনের কথা প্রকাশ্যে বলতে পারেন না। তাঁদের সিট ছেড়ে দিতে হবে না ? না দিলে তাঁরা রাস্তায় বের হউয়া ছেড়ে আবার ঘরে ঢুকে যাবেন না?

আমি বা আমরা, যদি গুনতে শুরু করি কেবল নারী বলেই আমরা ছোটবেলা থেকে কি কি প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারি নাই আর কি কি অপ্রয়োজনীয় কাজ করতে হয়েছে – অন্যদের কথা জানি না- আমি নিশ্চিত এই মুহূর্তে থু থু ফেলে ডুবে মরে যেতে ইচ্ছে করবে আমার।

কিন্তু সেটা যেহেতু সম্ভব না, যেটা করতে পারি সেটা হচ্ছে , চেষ্টা করতে পারি নারী হিসেবে আরেকজন নারীর পাশে নারী হয়েই দাঁড়াতে।সেটাই আমি সব সময় করি।

একবার সিস্টারহুড নামে একটা কবিতা লিখেছিলাম । বন্ধু রুমী হক জানতে চেয়েছিলেন ‘ সিস্টারহুডে’র বাংলা প্রতিশব্দ কি ? আমি বলতে পারি নাই । বাংলা না জানি , জিনিসটা কি তা তো জানি । আমার কাছে খুব সোজা । এমন এমন সব কাজ করা যা এখন পর্যন্ত বঞ্চিততর নারীকে এবং ভবিষ্যতের নারীকে বঞ্চনা থেকে বের হয়ে আসতে শিশির পরিমাণ হলেও সাহায্য করবে। সেই জন্যই নারী বলে, কেবল নারী বলেই যা যা হয়েছে, হচ্ছে আরও হবে – তাকে মনে রাখা। তার প্রতিবাদ করা। নারীর পাশে নারীর দাঁড়ানো। সব সময়।

মনে রাখতে হবে- ওরা ‘নারী’ বলছে নারীকে আরও পিছিয়ে দিতে আর আমরা ‘নারী’ বলছি আরও একটু এগিয়ে যেতে – দুইটা বলায় পার্থক্য আছে।

*উম্মে রায়হানা : স্নাতকোত্তর, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।

Leave a comment

Trending