উমে মারমা
১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার চাকমা অধ্যুষিত লো-গাং ইউনিয়নের এক পাহাড়ি গুচ্ছগামে আনসার, ভিডিপির প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় স্থানীয় এবং সেটলার বাঙালীরা যৌথ ভাবে হামলা চালায়। ব্রাশ ফায়ার করে পাহাড়িদের হত্যা করা হয়, আর আগুন দিয়ে পুরো গুচ্ছগ্রাম জ্বলিয়ে দেয়া হয়। গ্রামবাসীদের, তথা প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে এই হামলায় ১০০০ এর বেশী পাহাড়ি নিহত হন। অধিকাংশ লাশ গুম করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের কাছে এটি লো-গাং গণহত্যা নামে পরিচিত লাভ করে। এমনই এক ঐতিহাসিক দিনকে স্মরণে রাখার জন্য ‘ঠোটকাটার’ পক্ষ থেকে একজন এসে আমাকে অনুরোধ করল ১০ এপ্রিল লোগাং গণহত্যা নিয়ে একটা সাক্ষাত্কার ভিত্তিক লেখা লিখে দিতে পারবো কিনা। প্রস্তাব পাওয়ার সংগে সংগে সিদ্ধান্ত নিলাম একটা ‘লেখা’ দাড় করানোর কারণ, পাহাড়ে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় বাঙালীদের দ্বারা সংঘটিত হওয়া অনেক গণহত্যার ঘটনা সময়ের সাথে সাথে আমাদের মন থেকে ধুয়ে মুছে গেছে প্রায়। শুধু তারাই মনে রাখে যারা ঘটনার শিকার। আর পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। কিছু সচেতন পাহাড়ি নাগরিক যারা নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন। আর নতুন প্রজন্ম? কি বলব? এসব ঘটনার কিছুই জানেনা। লিখবো ঠিক করার পর চিন্তায় পড়ে গেলাম কিভাবে লিখবো। কোথা থেকে শুরু করবো। হাতে সময় খুবই কম। এই ঘটনার ২৩ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তখনকার ছোট্ট শিশু এখন ২৫ বছরের প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ। ঘটনার শিকার লোকজন এখন কে কোথায় আছে ? তাদের খুজে বের করতে হবে । তাই পানছড়িতে পরিচিত সবাইকে ফোন দেয়া শুরু করার পর একদিন একজন জানালো দুজন প্রতক্ষদর্শীকে খুজে পাওয়া গেছে। তাদের সাথে যোগাযোগ হল, ফোনে কথা হল এবং তারপর একদিন দেখাও হল। লো-গাং মানে রক্ত বন্যা, সেই রক্ত স্নাত স্মৃতি হেমরঞ্জন চাকমা আর অতুল চন্দ্র চাকমাকে আজও ক্ষত-বিক্ষত করে
অতুল চাকমার স্মৃতিতে লোগাং গণহত্যা:
লোগাং ঘটনার সময় অতুল চাকমা যদিও ক্লাশ ফাইভে পড়ত কিন্তু বয়স ছিল ১৩ বছর। শরনার্থী হিসাবে ভারতে থাকার কারনে পড়াশুনায় পিছিয়ে পড়ে অতুল। ৩ ভাই ৩ বোন অতুলরা। সবাই ছোট ছোট। যেদিন এই ঘটনা ঘটে তার প্রায় সবকিছু এখনো চোখে ভাসে । অতুল কে যখন বললাম সেদিনের ঘটনা বলতে তখন অতুল বেশ উত্তেজিত হয়ে গেল। চোখে মুখে বিষন্নতায় ভরে গেল। অতুল বলতে লাগল- ঘটনা ঘটে যাবার পর আমরা শুনেছি সেদিন নাকি সকাল বেলায় ৫ জন বাঙালী ছেলে কোথায় গরু চড়াতে গিয়েছিল। সেখানে কে বা কারা তাদেরকে গুলি করে। আমি লাশ দেখিনি কিন্তু শুনেছি তাতে ২ জন মারা যায়। যারা বেচে গিয়েছিল তারা ফিরে এসে ঘটনাটা জানাই। এরপরে শুরু হয় বাঙালীদের উত্তেজনা। এইবার তারা মিছিল করবে আর চাকমা কেটে ফেলবে বলে শ্লোগান দিতে থাকে। তখন অবশ্য তারা বলেনি যে আমাদের গুচ্ছগ্রামে এসে হামলা করবে। তাদের সাথে ভিডিপি, আনসার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে এসে সেখান থেকে সরাসরি চাকমা রক্ত চাই, চাকমা রক্ত চাই বলে শ্লোগান দিতে দিতে আমাদের গুচ্ছগ্রামে চলে আসে। আমরাতো তখন কিছুই জানিনা। তাই তাদের আক্রমণে ভয়ে প্রাণ বাচাঁতে এদিক সেদিক দৌড় দিতে লাগলাম। বাঙালিরা আনসার ভিডিপি সহ এসেই ব্রাশ ফায়ার করা শুরু করলো।
গুচ্ছগ্রামের সব ঘর একলাইন জুড়ে। আমাদের বাড়িটি ছিল ১০ টা ঘরের পরে। গ্রামের সবাই পালালেও আমরা পালাইনি যেহেতু আমাদের সবার ছোট ভ্ইাটি খুব ছোট তাই আমরা লুকিয়ে ঘরের ভিতর ছিলাম। ।ভেবেছিলাম হয়তো খুজে টুজে চলে যাবে। কিত্তু যখন গুলি করা শুরু করল তখন আমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম, আমার মেঝ ভাইটি একটু পর পর মাথা তুলে দেখছিল যে যদি কিছু দেখা যায়। এদিকে গ্রামের প্রথমে আগুন লাগিয়ে দেয়ার পর চোখের নিমেষে আগুন আমাদের বাড়ীতে এসে পৌছাঁলে আমরা আর থাকতে না পেরে ঘর থেকে বের হয়ে যে যেদিকে পারলাম দৌড় দিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে গুচ্ছগ্রামের পাশে যে ত্রিপুরা গ্রাম আছে আর তার পাশে যে জংগলটা আছে সেখানে লুকিয়ে পড়লাম। একটু পরে ওখানে আমার জেঠাতো বোন আল্পনা এসে পৌঁছালে দেখলাম তার শরীর রক্তে রক্তাক্ত। তার পায়ে দায়ের কোপের আঘাত। কিন্তু তার সারা শরীর রক্তে রক্তাক্ত। তার একটু পর বাচ্ছু, সে হচ্ছে আমার ভাগ্নে সেও দায়ের কোপে আহত অবস্থায় এখানে আসল। আল্পনা জানাল যে- তাকে দা দিয়ে কুপিয়েছে বাশার। যখন বাশার তাকে কাটতে উদ্যত হয়েছিল তখন আল্পনা বলেছিল যে, আমি প্রতিদিন তোমার মিলে গিয়ে ধান মাড়াই করি। সেই তুমি আমাকে দা দিয়ে কোপাচ্ছ। তখন নাকি বাশার বলেছিল- আমি যদি তোমারে না কাটি তাহলে অন্য বাঙালীরা এসে কেটে মেরে ফেলবে বলে বাশার তাকে পায়ে কোপ দিয়ে চলে যায়। আল্পনার সামনেই সে আরো দুজনকে মেরে ফেলেছে তাদের মধ্যে একজন বয়স্ক নারী আর তার নাতনি। যখন সে দেখল অনেক বাঙালী আসতেছে তখন সে বুদ্ধি করে তাদের রক্ত নিজের শরীরে মেখে মরার ভান করে পড়ে থাকল। তারপর তারা চলে যাবার পর দৌড়ে এসে জংগলে ঢুকেছে। আল্পনার বয়স তখন ১৫/১৬ বছর।
আগুন দিয়ে সব গ্রাম পুড়িয়ে শেষ করে দেবার পরও আমরা জংগল থেকে বের হইনি। ত্রিপুরা গ্রামে আমরা যেতে পারিনি। কারন বিডিআর আর আনসাররা তাদেরকে মানা করে দিয়েছিল যে যেন তারা আমাদেরকে জায়গা না দেয়। তারা ত্রিপুরাদের ঘর চেক করেছিল কেউ লুকিয়ে আছে কিনা। সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পর আর্মিরা পানছড়ি জোন থেকে এসে বাঙালী মেম্বারদের সাথে নিয়ে আমাদের খোঁজতে শুরু করল। উচ্চস্বরে ডাকতে ডাকতে বলল- কারা কোথায় কোথায় আছো চলে আসো। ফিরে আসো। দেখে যাও তোমাদের কি পুড়ে গেছে। কারা আহত হলো, কারা কারা মারা গেছে খোঁজ নিতে আস, বলে ডাকতে লাগল। তারপরও আমরা জংগল থেকে বের হইনি ভয়ে। তারপর তারা জংগলে এসে আমাদের খুঁেজ খুঁেজ বের করল আর বলল – এখন ভয়ের কিছু নেই। তোমরা ফিরে আস দেখ কারা মারা গেছে আর কারা আহত হয়েছে। তারপর আমরা বের হলাম। আমি জংগল থেকে বের হয়েই দেখলাম ৪ টা লাশ পড়ে আছে। তাদের মধ্যে একজনকে চিনলাম- জগা বাপ । সে গুলিতে মারা গেছে।
গ্রামে এসে শুনলাম ১০০০/১২০০ জন মারা গেছে। ঘরের ভিতরেই অনেক মানুষ পুড়ে গেছে। আমি পুড়ে যাওয়া একটা মেয়েকে দেখলাম। মুখ থুবরে পড়ে আছে। পুরো শরীর পুড়ে গেলেও চুল আর পায়ের নখ পুড়ে যায়নি। ঐ পাখের নখে নেল পালিশ তখনো দেখা যাচ্ছে। আমার নিজের চোখে দেখা। গ্রামের পথ দিয়ে হাটছি আর আমরা সবাই সবাইকে দেখে কাদঁছি। ঘরের কোন সম্পত্তি আর অবশিষ্ঠ নেই। যদিও আমাদের পরিবারের কারোর কিছু হয়নি তবু কাদঁছি সবাই। এর আগে বাবা আমাদের খোঁজে গোল ঘরে গিয়েছিল। সেখানে অনেক লাশ ছিল। একজন বিডিআর বাবাকে সাহায্য করেছিল লাশের ভিতর আমাদের খোঁজতে। বাবার ধারনা ছিল আমরা সবাই মারা গেছি।
সব কিছু শেষ হবার পর আমাদেরকে সেনাবাহিনীরা লোগাং প্রাইমারী স্কুল ঘরে নিয়ে গেল। হলুদ সিদ্ধ করা হয় যে ড্রামে সে ড্রামে আমাদের জন্য ভাত রান্না করে দিয়েছিল সেনাবাহিনীরা। হলুদের গন্ধে ভাত মুখে দেয়া কঠিন ছিল। অবশ্য সে সময় ভাত খেতে কি মন চাই? তখন গ্রামের সকলে আর্মিদের বলল আমরা যদি আজকে এখানে থাকি তাহলে রাতে আমাদের বাঙালীর কেটে ফেলবে। সেনাবহিনীরা জীজ্ঞেস করল – তাহলে তোমরা কোথায় যেতে চাও? আমরা বললাম আমরা আমাদের নিজেদের জন্মভিটায় ফিরে যেতে চাই। এই গুচ্ছগ্রামে তো অনেক গ্রামের মানুষ যেমন তারাবন্যে , জগাপাড়া, হারুবিল ও আরো অনেক গ্রামের মানুষের বসতি ছিল। তাই আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম আর এখানে থাকবোনা, সিদ্ধান্তের পরপরই সন্ধ্যা হবার আগেই রওয়ানা দিলাম নিজেদের জন্ম ভিটার উদ্দেশ্যে। আহত লোক যারা লাঠি খেয়েছে দা’র কোপ খেয়েছে তারা সহ আমরা হাটা দিলাম। ১৯৮৯ খ্রীষ্টাব্দে আমরা গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। শরনার্থীথেকে ফেরত আসার পর এই গুচ্ছগ্রামে আমাদেরকে সেনাবাহিনীরা বাধ্য করেছিলো বসতি করতে তারপর পরিকল্পিত ভাবে হত্যাকান্ড ঘটালো। অনেক আত্মীয় স্বজন হারিয়ে লাশ করিয়ে তবেই আমাদের মুক্তি মেললো। সন্ধ্যার দিকে আমরা আমাদের ভিটেমাটিতে পৌছঁলাম। ওখানে খামার বাড়ীতে উঠলাম। ২/৩ দিন থাকার পর আমরা শন কেটে, পলিথিন কিনে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে নিলাম। ্আমরা জনসংখ্যায় কম। তাই ভয়ে কাছাকাছি জায়গায় বাড়ী করলাম। এতকিছু হারার পরেও আমাদের সবার নিজ নিজ ভিটায় থাকা হলনা। ”
হেম রঞ্জন চাকমার স্মৃতিতে লোগাং গণহত্যা:
১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল যখন লো-গাং হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল তখন হেম রঞ্জন চাকমার বয়স ছিল ১৬/১৭ বছর এবং এসএসসি পরীক্ষার্থী (সে সময়ে মেট্্িরক পরীক্ষা এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হতো)। সেদিনের কিশোর ছেলেটি আজ এখন মধ্যবয়সী। লো-গাং হত্যাকান্ড্রে ২৩ বছর পর যখন সে সময়ের ঘটনার কথা শুনতে চাইলাম তখন হেম রঞ্জন বেশ অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো। চোখে অনেক জীজ্ঞাসা
– এত বছর পর কেন আমি লো-গাং নিয়ে শুনতে চাইছি?
– আমি কোন এনজিওতে কাজ করি ?
– আমি কোন কু-মতলব নিয়ে তার কাছে এসেছি কিনা?
অনেক ভয়, শংকা এবং নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে যখন সে তার দু:খের ঝাপি খুললো তখন তার চোখ মুখ জুড়ে শুধু আতংক আর আতংক। আতংকের কারণে মাঝে মাঝে খুব নীচু স্বরে কথা বলছিল – কথা বুঝা যাচ্ছিলনা। ২৩ বছর পরের লো-গাং এর ঘটনা যেন তার কাছে গতকালের ঘটনা। গুলি ব্রাশ ফায়ার বদ্ধ ঘরে আগুন লাগানো, তারপর জান নিয়ে পালানোর চেষ্টা, তারপর মাথায় দা’র কোপ নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় জংগলে লুকিয়ে থাকা সব সব চোখের সামনে এখন তার। কথা বলতে বলতে হেম রঞ্জন চাকমা ফিরে গেলেন ১৯৯২ সালে ১০ এপ্রিল সকালে-
“ আমি তখন মেট্্িরক পরীক্ষার্থী। বিঝু’র পর পরই পরীক্ষা হবে। তাই পড়াশুনা করতে হচ্ছে । একই সাথে ২/৩ দিন পর বিঝু তাই আমরা ভীষণ আনন্দে ছিলাম। আমরা ৩ ভাই ১ বোন। আমাদের আসল গ্রাম হচ্ছে তারাবুন্যে আদাম। আমার জন্ম বড় হয়ে উঠা সেখানেই। কিন্তু পাহাড়ের খারাপ পরিস্থিতির কারনে আমাদের গ্রামের সবাইকে তারাবুন্যে গ্রাম ছেড়ে শরনার্থী হিসাবে ভারতে চলে যেতে হয়। সেটা ১৯৮৯ সালের প্রথম দিকে। ওখানে শরনার্থী শিবিরে অসুস্থ পরিবেশে বেশ কয়েক মাস থাকার পর সেই বছরই শেষের দিকে আবার আমরা চুরি করে নিজেদের দেশে চলে আসি এবং সেনাবাহিনী ক্যাম্পে গিয়ে স্যারেন্ডার করি। কিন্তু সেনাবাহিনী আমাদেরকে নিজেদের গ্রামে যেতে না দিয়ে এই লো-গাং গুচ্ছগ্রামে এনে রাখে। এই গুচ্ছগ্রামের আগের নাম ছিল ব্রাম্মন পাড়া। আমাদের এই গুচ্ছগ্রামের পাশে ছিল বাঙালী গ্রাম। সেদিন সকাল ১০টা হবে। আমার বাবা মা একটু দূরে জমিতে গেছে ধান লাগাতে। আমি বাসায় পড়তে বসেছি। হঠাৎ শুনি অনেক হৈ চৈ শব্দ। ঘরের বাইরে বের হয়ে দেখি আনসার ভিডিপি আর বিডিআর (এখন বিজিবি) সহ অনেক বাঙালী দৌড়ে আমাদের দিকে আসছে। তাদের মধ্যে ৫/৬ জন বাঙালী আমাদের বাড়ীর দিকে দৌড়ে এসে আমাদের বলল -এই তোমরা ঘরের ভিতর ঢুকো। যাদেরকে পাচ্ছে তাদের সকলকেই ঘরের ভিতর ঢুকতে বলল। আমরা সকলেই নিত্য জ্যোতি চাকমার বাড়ীতে ঢুকলাম। বাড়ীটা দো-চালার। আমরা ১০/১২ জন তখন ঐ ছোট্ট ঘরে। তারপর বাইরে থেকে বাঙালীরা দরজা বন্ধ করে দিল এবং ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। ঘরে আগুন দেয়ার পর তারা দা লাঠি নিয়ে দরজার বাইরে দাড়িয়ে থাকল যাতে আমরা ঘরের ভিতর থেকে বের হতে না পারি। এদিকে আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে প্রাণ বাচাঁতে আমরা দরজা ভেঙ্গে ঘরের বাইরে বের হতেই একজন বাঙাল দা নিয়ে আমার মাথায় কোপ দেয়। ঐ অবস্থায় প্রাণ বাচাঁনোর তাগিদে আমি সহ সকলেই দিকবিদিক দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। সামনেই ছিল ত্রিপুরাদের আরেকটি গ্রাম। আমি সেদিকে যেতে চাইলে দেখি চারিদিকে বিডিআর। বিডিআররা আমাকে দেখার পর আমাকে থামাল। তখনও আমার মাথা থেকে রক্ত পড়ছিল। আমি মাথার ঘা হাত দিয়ে চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। অনেকক্ষণ বিডিআররা আমাকে আটকে রাখার পর দুপুরের দিকে মা-বাবা আমাদের খোঁজে সেখানে এলে তারা আমাকে ত্রিপুরার বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে ‘দুন্ধ মিধা’( তামাক গুড়) লাগিয়ে দেয়। যাতে রক্ত বন্ধ হয়। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী পানছড়ি থেকে চলে আসে। তখন দুপুর গড়িয়ে ৩/৪ টা বেজে গেছে। আমাদের গুচ্ছগ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ততক্ষণে। এদিকে আমার অন্য ভাইবোনদের খবরও তখন জানিনা। তারা কি বেঁেচ না বাঙালীদের হাতে মারা গেছে ভাবতে ভাবতে সেনাবাহিনীরা এসে আমাদের গুচ্ছগ্রামের কাছে লোগাং বাজার প্রাইমারী স্কুল ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সেনাবাহিনীরা আমার মাথায় ঔষধ লাগিয়ে দেয়। ওখানেই পৌঁেছ আমি আমার ভাইবোনদের খুজে পেলাম। কিন্তু আমার বড়বোন সূর্যমিকা চাকমা আহত হয়েছে। তাকে লাঠি দিয়ে মারা হয়েছে। সে যখন জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছিল তখন বাঙালীরা পিছন থেকে লাঠি দিয়ে মারে। কিন্তু ভাগ্য ক্রমে সে বেঁেচ যায়। স্কুল ঘরে তখন গ্রামের অনেকে চলে এসেছে। অনেক আহত লোকজন। ৮ জনেরও বেশী আহত লোককে দেখতে পেলাম। তার মধ্যে অমিয় কান্তি চাকমা, তার বাম হাতে গুলি লেগেছে। ইতিমধ্যে খবর আসল অমিয় কান্তির মেয়ে তনা চাকমা (৭) আগুনে পুড়ে মারা গেছে। সেকি হৃদয় ভাঙ্গা দৃশ্য। সবাই জোরে জোরে কাদঁছে আর ভগবান বুদ্ধের নাম নিচ্ছে। আমরা যে বেঁেচ যাব কেউতো ভাবিনি। বুদ্ধজয় মা গুলিতে আহত, পাগলি, নিরজ্ঞন,সুমিত্রা, অরুন, ইন্দু বিকাশ সবাই দা’র কোপে এবং লাঠির আঘাতে আহত হয়েছে।
এদিকে গ্রামের অনেকের মৃত্যু খবর স্কুল ঘরে পৌঁেছ গেছে। সবার মধ্যে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। অনেকে তাদের পরিবারের সদস্যদের খুঁজে পাচ্ছেনা তাই কাঁদছে। কেমন আছে কোথায় আছে। এই কথা কি বলে বুঝানো যায় বলো ! তবে আমার মনে পড়ে আমি ১৩ টি লাশ দেখেছি যখন গ্রামের পাশ দিয়ে স্কুল ঘরে আসছিলাম। লাশ গুলো এখানে ওখানে পড়ে আছে। আর স্কুল ঘরের পাশে একটা গোল ঘরে অনেক লাশ রাখা ছিল। বাবা সেই গোল ঘরে গিয়েছিল আমাদের খুজতে মানে আমাদের লাশ খুজঁতে। দেখে এসেছে অগণিত লাশ। সবাই বলাবলি করছিল ১০০০ এর বেশী মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। কারণ ৫০০ পরিবাবের মতন ছিলাম আমরা এই গুচ্ছ গ্রামে। সেদিন বাঙালীদের হাত থেকে নিজের জীবন বাচাঁতে অনেকে অনেক দূরে পালিয়ে গিয়েছিল। তারা আর গুচ্ছগ্রামে ফিরে আসেনি। গুচ্ছগ্রামে সেদিনের বাঙালীদের হামলার পর দিনের শেষে পাহাড়িদের দাবীর মুখে সেনাবাহিনী এসে বলল -এইবার তোমরা নিজেদের গ্রামে ফিরে যেতে পার।
তখনতো এতো কিছু বুঝিনা। এখন বুঝি কেন সেনাবাহিনীরা শরনার্থী থেকে ফেরার পর নিজেদের গ্রামে যেতে না দিয়ে এই গুচ্ছগ্রামে থাকতে আমাদের বাধ্য করেছিল। এই গুচ্ছগ্রামে লোগাং এলাকার অনেক গ্রামের মানুষকে থাকতে বাধ্য করেছিল আর্মিরা। কিন্তু রেশন হিসাবে দিত মাত্র মাথা পিছ ু ১০কেজি। তেল দিত। আর নিজেদের টাকায় ঘর তুলতে বাধ্য করত সেনাবাহিনীরা। কথায় আছে চোরে যখন চুরি করে নিয়ে যায় তখন কিছুনা কিছু গৃহস্থের জন্য রেখে যায়। আর আগুনে যখন নেয় তখন সবকিছু নিয়ে চলে যায়। প্রত্যেক পরিবারে বছরের ধান ছিল সবার। বিঝু উপলক্ষ্যে কেনা অনেক কিছু ছিল। সংসারের জমানো কতকিছু ছিল ।আসলে সবতো বলা যায়না। সেগুলো পুড়িয়ে দিয়ে মানুষ মেরে সেনাবাহিনীরা তারপর আমাদের নিজেদের ভিটায় ফিরতে দিল। এখন তাই মনে হয় সব ছিল পরিকল্পিত। (দীর্ঘশ্বাস)”
উমে মারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন ব্লগার।
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply