Image: Activist Anthropologist
Image: Activist Anthropologist

নাফিসা তানজীম

[গত কয়েক বছরে তাজরীন অগ্নিকান্ড ও রানা প্লাজা ধসের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাসমূহের কাজের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে পোশাক উৎপাদন করা কর্পোরেশানগুলো নিজেদের ব্র্যান্ড ইমেজ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে। এর প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে “অ্যাকর্ড ফর বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ” ও “অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি” নামে দুটো কর্পোরেট কোড আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ইতিহাসে কর্পোরেট কোড অফ কন্ডাক্ট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নতুন কিছু নয়। অতীতে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকবার এধরণের কর্পোরেট কোড গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এই কোডগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা মহলে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে।

কর্পোরেট কোড অফ কন্ডাক্টের সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো কী কী? এই ধরণের কোড কাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়? শ্রমিকের জীবন ও কাজের পরিবেশের বস্তুগত পরিবর্তন আনতে কর্পোরেট কোড কতখানি ভূমিকা রাখতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে বাংলাদেশের শ্রমিকের জীবন ও কাজের মান উন্নয়নের লক্ষ্যে নব্বইয়ের দশকে হার্কিন বিল পরবর্তী সময়ে গৃহীত একটি মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং এবং একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রণীত অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের উদাহরণ বিশ্লেষণ করে কর্পোরেটকেন্দ্রিক বিভিন্ন শ্রম অধিকার বিষয়ক উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা এবং এর পেছনে কাজ করা বিভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির স্বরুপ উন্মোচন করতে হার্কিন বিল থেকে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সঃ কর্পোরেটকেন্দ্রিক শ্র্ম অধিকার বিষয়ক উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা এই বিষয়ে নাফিসা তানজীমের ধারাবাহিক লেখার শেষ পর্ব ]

নব্বইয়ের দশকের হার্কিন বিল ও MOU অথবা একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের কারখানার মালিক, শ্রমিক ও শ্রমিকনেতাদের মাঝে তৈরি হওয়া উদ্বেগ কর্পোরেটকেন্দ্রিক শ্রম আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাকে মূর্ত করে তোলে। নাওমি ক্লেইন তাঁর “নো লোগো” বইয়ে ব্র্যান্ড এবং কর্পোরেটকেন্দ্রিক শ্রম আন্দোলনের সমালোচনা করতে গিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। ক্লেইনের আলোচনের প্রেক্ষিতে এবং হার্কিন বিল-অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের উদাহরণের ভিত্তিতে বাংলাদেশের শ্রম আন্দোলনে কর্পোরেট হস্তক্ষেপের প্রভাব নিচে বিশ্লেষণ করা হলো।

কর্পোরেশন প্রণীত বিভিন্ন কোড অফ কনডাক্ট, মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং, কোড অফ এথিক্‌স বা কোড অফ প্রিন্সিপাল ব্র্যান্ডনির্ভর আন্দোলনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। ব্রুকসের আলোচনায় হার্কিন বিল পরবর্তী সময়ে প্রণীত MOUএর সীমাবদ্ধতার বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। MOU বা অ্যালায়েন্সের মত কোড অফ কনডাক্টগুলোতে সাধারণত আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকে না। এই কোডগুলো খুব কম সময়েই শ্রমিকদের সাথে সরাসরি আলোচনা করে প্রণয়ন করা হয়। কর্পোরেশানের পাবলিক রিলেশান ডিপার্টমেন্টগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের মত করে এসব কোড তৈরি করে। তাদের সহযোগিতা করেপশ্চিমা বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং তাদের সমমনা তৃতীয় বিশ্বের প্রতিষ্ঠানসমূহ (ক্লেইন, ৪৩০)। অ্যাকর্ডের গঠন প্রক্রিয়া বাহ্যিকভাবে কিছুটা ভিন্ন হলেও অ্যালায়েন্সের মাঝে আমরা ক্লেইন উল্লিখিত সীমাবদ্ধতার প্রতিটি লক্ষ্য করি।

কর্পোরেট কোডগুলোর মূল উদ্দেশ্য থাকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের প্রশমিত করা। বস্তুগত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের বিষয়টি থাকে গৌণ। কোডগুলো বেশিরভাগ সময়ে লেখা হয় ইংরেজি বা অন্য কোন আধিপত্যবাদী ভাষায়। শ্রমিকদের স্থানীয় ভাষায় এগুলো কদাচিৎ অনুদিত হয়। গ্লোবাল অ্যাসেম্বলি লাইনে কন্ট্রাকটর এবং সাব-কন্ট্রাকটরদের জটিল মিথষ্ক্রিয়ায় এই কোডগুলো সাধারণত অর্থবহ পরিবর্তন আনতে পারে না। অনেকক্ষেত্রে বিভিন্ন কোডের মাঝে সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়। ক্লেইন তাঁর আলোচনায় দেখিয়েছেন, কীভাবে বিভিন্নধরণের কোডের ভিড়ে প্রায়শ প্রতিটি কোডের যথাযথ বাস্তবায়নের দিকে নজর দেয়া সম্ভব হয় না (ক্লেইন, ৪৩১)।আমেরিকা ও ইউরোপের ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কোনটিতে স্বাক্ষর করা হবে তা নিয়ে সুস্পষ্ট মতবিরোধ আছে। গ্যাপ ও ওয়ালমার্টের মত অনেক ব্র্যান্ড তূলনামূলকভাবে শিথিল অ্যালায়েন্সের পক্ষপাতী। অপরদিকে ইউরোপের এইচ অ্যান্ড এম, মার্ক অ্যান্ড স্পেন্সার, যারাসহ অন্যান্য অনেক ব্র্যান্ড অ্যাকর্ডকে সমর্থন করেছে। আমেরিকার অনেক রাজ্যে এখন ভোক্তা ও শ্রম অধিকার সংগঠনসমূহ আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলোকে অ্যালায়েন্সের পরিবর্তে অ্যাকর্ড বাস্তবায়ন করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে আন্দোলন করছেন। এই প্রেক্ষাপটে প্রায় একই সময়ে প্রণীত অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের মাঝে সমন্বয়ের অভাব সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের যেসব কারখানা একই সাথে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সে স্বাক্ষরকারী ব্র্যান্ডের জন্য উৎপাদন করে, তাদেরকে কর্মপরিবেশের কোন ধরণের মানদন্ড অনুসরণ করতে হবে বা তারা বিভিন্ন ব্র্যান্ড থেকে কোন ধরণের আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপূরণ পাবে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ও সংগঠনের মাঝে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নিয়ে বিভ্রান্তি এবং অসন্তোষ লক্ষ্য করা গেছে।

ক্লেইনের মতে, কোড প্রণয়নের সময় অনেকক্ষেত্রে মানবাধিকার ও শ্রম সংগঠনসমূহ যেভাবে কর্পোরেশানগুলোকে প্রশ্নাতীতভাবে সহযোগিতা করে তা বিস্ময়কর। মানবাধিকার ও শ্রম সংগঠন এবং কর্পোরেশানের উদ্দেশ্য ও কার্যপ্রণালী এক হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মানবাধিকার ও শ্রম সংগঠন যখন কাঠামোগত বৈষম্যকে প্রশ্ন না করে কর্পোরেশানের মত আচরণ করতে শুরু করে, তখন পুরো ব্যাপারটি ভীষণ হতাশাব্যঞ্জক হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় দেখা যায় মানবাধিকার বা শ্রম অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা দেশের নিজস্ব শ্রম আইনের লঙ্ঘণকে গুরুত্ব না দিয়ে কর্পোরেট কোড অফ কনডাক্ট লঙ্ঘিত হওয়াকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। অথচ কর্পোরেট কোডগুলোর বেশিরভাগই লঙ্ঘণকারীর বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে না। আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকে সাধারণত দেশীয় শ্রম আইনে। অনেক অ্যাক্টিভিস্টের মতে দেশীয় আইনের লঙ্ঘণের চেয়ে কর্পোরেশানের কোড অফ কনডাক্ট লঙ্ঘিত হওয়াকে আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে তুলে ধরতে পারলে আন্তর্জাতিক প্রেস, মানবাধিকার সংগঠন এবং জনগণের সমর্থন তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া যায় (ক্লেইন, ৪৩৫-৪৩৭)।

ক্লেইনের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, অ্যালায়েন্স কর্পোরেশন কর্তৃক প্রণীত একটি একপাক্ষিক কোড। একারণে অ্যালায়েন্স অনেক শ্রম ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী ও সংগঠনের কঠোর সমালোচনার শিকার হয়েছে। অপরদিকে অ্যাকর্ড প্রণয়ণের বিভিন্ন ধাপে ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন, ম্যাকুইলা সলিডারিটি নেটওয়ার্ক, ওয়ার্কার রাইটস কনসর্শিয়াম, ইনডাস্ট্রিঅলের মত আন্তর্জাতিক সংগঠনের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠন বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলো। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে অনেক শ্রমিক সংগঠনের কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের কোন কোন সংগঠন অ্যাকর্ড বিষয়ক আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে তা নির্ধারণ করার প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি প্রতিনিধিত্বমূলক ছিলো না। আবার শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে যারা অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন, তাদের অনেকেই সিদ্ধান্তগ্রহণে কর্পোরেশানের আধিপত্যের ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন। সুতরাং কর্পোরেশান ছাড়াও ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রম অধিকার সংগঠন ও এনজিওদের সাথে আলোচনা করে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে অ্যাকর্ড প্রণয়ন করা হয়েছে দাবী করা হলেও শ্রমিকের কল্যাণসাধন অ্যাকর্ডের প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু ছিলো না। কর্পোরেশানের স্বার্থকে সর্বাধিকার দিয়ে ব্র্যান্ড ইমেজ রক্ষার জন্য কারখানার কর্মপরিবেশের যতটুকু পরিবর্তন আনা দরকার ঠিক ততটুকু পরিবর্তন আনার জন্য অ্যাকর্ড কাজ করছে।

ক্লেইনের মতে, ব্র্যান্ডনির্ভর উদ্যোগ মনে করে ভোক্তা চাইলেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ভোক্তার হাতে পরিবর্তনের কিছু ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু ভোক্তা কখনই সকল ক্ষমতার উৎস নয়। ব্রুকসের আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে ব্র্যান্ডনির্ভর অ্যাক্টিভিজম কীভাবে ধরেই নেয় যে প্রথম বিশ্বের ভোক্তাদের পক্ষে তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদের সকল সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। ব্র্যান্ডনির্ভর অ্যাক্টিভিজম প্রথম বিশ্বের লেন্স দিয়ে তৃতীয় বিশ্বকে দেখে এবং তৃতীয় বিশ্বের স্থানীয় চিত্র, সম্পর্ক, আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি, সীমাবদ্ধতা এবং সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে। এটি তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিককে অসহায়, ক্ষমতাহীন এবং প্রথম বিশ্বের ভোক্তা ও কর্পোরেশানের মুখাপেক্ষী হিসেবে চিত্রিত করে। ক্লেইন দাবী করেছেন, ব্র্যান্ডনির্ভর আন্দোলন ভোক্তাকেন্দ্রিক হওয়ায় এটি ভোক্তা যেসব পণ্য ভোগ করে শুধু সেসব পণ্যের উৎপাদকের কাজের পরিস্থিতির দিকে নজর দেয়। এটি পশ্চিমা ভোক্তা যাতে কোন ধরণের অপরাধবোধে না ভুগে নিশ্চিন্তমনে শপিং করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে চায়। ফলে ব্র্যান্ডনির্ভর আন্দোলন অনেকসময় “এথিক্যাল শপিং গাইড” নিয়ে উপস্থিত হয়। প্রথম বিশ্বের ভোক্তা তখন নাইকির জুতা না কিনে অ্যাডিডাসের জুতা কিনে সন্তুষ্ট থাকে এবং বৈশ্বিক ও স্থানীক কাঠামোগত বৈষম্য, মুক্তবাজার অর্থনীতি বা নিওলিবারেল নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়োজনবোধ করে না (ক্লেইন ২০০০, ৪২১-৪২২)।

নব্বইয়ের দশকের হার্কিন বিল বা ওয়ালমার্টের “মেইড ইন আমেরিকা” ক্যাম্পেইন শিশু অধিকার রক্ষার সহজ সমাধান খুঁজে পেয়েছিলো বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য বয়কটের মধ্য দিয়ে। অথচ বাংলাদেশের শিশুরা কেন কাজ করতে বাধ্য হয়, কারখানায় শিশুদের নিয়োগ বন্ধ করা হলে এই শিশুরা কোথায় যাবে, আমেরিকার পণ্য ব্যবহার করলেই কি বাংলাদেশের শিশুদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটবে কিনা এবং পুরো পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন করতে হলে দীর্ঘমেয়াদে কোন ধরণের উদ্যোগ নেয়া উচিত – এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো হার্কিন বিল বা “মেইড ইন আমেরিকা” ক্যাম্পেইন উদ্দেশ্য করেনি। আবার একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে আমরা লক্ষ্য করি অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্সের মত উদ্যোগগুলোও মুক্ত বাজার অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করে। কখনও কখনও বাহ্যিকভাবে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও সংগঠনকে পরিকল্পনা বিষয়ক আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার সবসময় কর্পোরেশানেরই থাকে। ফলে কর্পোরেশানের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কোন মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রস্তাব অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্স দেয় না। বর্তমানে প্রথম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন, ম্যাকুইলা সলিডারিটি নেটওয়ার্ক বা ইউনাইটেড স্টুডেন্টস এগেইনস্ট সোয়েটশপের মত সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে ব্র্যান্ডগুলোকে অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্সে স্বাক্ষর করানোর লক্ষ্যে ভোক্তাগণ আন্দোলন করে যাচ্ছেন। ভোক্তার ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্রয়ক্ষমতাকে মূল শক্তি হিসেবে ধরে বয়কটের হুমকি দিয়ে ব্র্যান্ডগুলোর ওপর অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্সে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ তৈরি করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হয়তো মহৎ হলেও প্রথমবিশ্বের ভোক্তাগণ আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছেন কর্পোরেশন প্রণীত একটি কোড। তৃতীয় বিশ্বের সরকার বা আইএলও প্রণীত শ্রমবিষয়ক আইন ও নীতি বাস্তবায়নের দাবীর পরিবর্তে কর্পোরেশানের নেতৃত্বে তৈরি করা একটি প্রাইভেট কোড বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্স বিষয়ক পূর্বের আলোচনা এবং নব্বইয়ের দশকের উদাহরণের প্রেক্ষিতে ক্লেইনের সাথে একমত প্রকাশ করে বলা যায়, অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্সকে কেন্দ্র করে ভোক্তা বা কর্পোরেশানদের নেয়া উদ্যোগসমূহ পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশের দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই পরিবর্তন আনবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম।

ব্র্যান্ডনির্ভর অ্যাক্টিভিজম অনেক ক্ষেত্রে সার্বিক পরিবর্তনের পরিবর্তে প্রতীকী রুপ নেয়। নাইকিকে বয়কট করা হলে অ্যাডিডাস হয়তো বিকল্প পছন্দ হিসেবে এগিয়ে যায়। শেলের কর্পোরেট দমননীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় দেখা গেলো শেলের হারানো কনট্রাক্টগুলো পেয়ে যাচ্ছে শেভরন। এভাবে ক্রেতাদের সামনে একটি কর্পোরেশনের পরিবর্তে অন্য আরেকটি কর্পোরেশান নীতিগত বিকল্প হিসেবে উপস্থিত হয়। অথচ শ্রমিকের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে অ্যাডিডাস বা শেভরন যে নাইকি বা শেলের চেয়ে বেশি সচেতন তা বলা যায় না। এই কোম্পানিগুলোর প্রত্যেকে সর্বোচ্চ মুনাফা লাভের জন্য তৃতীয় বিশ্বের সস্তা শ্রমকে নানাভাবে দমন ও নিপীড়ন করছে (ক্লেইন ১৯৯৯, ৪২২-৪২৪)। রানা প্লাজায় দুর্যোগের পরবর্তী সময়ে শুধু এক ব্র্যান্ড যে অপর ব্র্যান্ডের নীতিগত বিকল্প হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে তা নয়, কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নের জন্য ব্র্যান্ড কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের একটিকে অপরটির নীতিগত বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ব্র্যান্ডগুলো তাদের সুবিধা অনুযায়ী অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্সে স্বাক্ষর করে নিজেদের ব্র্যান্ড ইমেজ রক্ষা করার চেষ্টায় ব্যাপৃত।

ব্রুকসের আলোচনায় আমরা MOUকে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কাজ করা মাত্র ৪% শিশুর অধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে দেখি। কিন্তু বাকি যে ৯৬% শিশু অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কাজ করে, অর্থাৎ কর্পোরেট ব্র্যান্ডের সাথে যাদের সরাসরি যোগাযোগ নেই, তাদের অধিকার বা কাজের পরিবেশ নিয়ে MOU, কর্পোরেশান বা শ্রম আন্দোলনের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কর্মীদের কেউই তেমন এগিয়ে আসেনি। শ্রম আন্দোলন অতিরিক্ত ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক হয়ে গেলে যেসব শ্রমিকের সাথে ব্র্যান্ডের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই, সেসব শ্রমিকের অধিকারের বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। ক্লেইন বলেছেন, যে শিশুরা ফসলের মাঠে বিষাক্ত কীটনাশকের মাঝে বা বিপদজনক মাইনপূর্ণ এলাকায় অথবা স্টিল ফ্যাক্টরিতে কাজ করে, তাদের কেউই সকার বল তৈরি করা শিশুদের মত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে না (ক্লেইন, ৪২৪)। একই ব্যাপার আমরা লক্ষ্য করি অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের ক্ষেত্রেও। দুটি উদ্যোগই শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় টায়ারের কারখানাগুলোকে লক্ষ্য করে কাজ করে কারণ এই কারখানাগুলোর সাথে ব্র্যান্ডের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে। কিন্তু বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ কারখানা তৃতীয় টায়ারে পড়ে (বিয়ারনট)। এই কারখানাগুলো সাবকন্ট্রাক্টের মাধ্যমে প্রথম ও দ্বিতীয় টায়ারের কারখানাগুলোর কাছ থেকে অর্ডার নেয়। ব্র্যান্ডের সাথে সরাসরি কাজ না করায় অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্সের কোন প্রভাব এই কারখানাগুলোর ওপর পড়বে না। অ্যালায়েন্স সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়ার চর্চাকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। সাব-কন্ট্রাক্ট নিষিদ্ধ করা হলেই যে সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়া বন্ধ হয়ে যাবে তা হয়। সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন ও ব্র্যান্ডের অস্বাভাবিক কম দামে পণ্য সরবরাহের দাবী পূরণের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় টায়ারের কারখানাগুলো বার বার তৃতীয় টায়ারের কারখানাগুলোর শরণাপন্ন হবে। কিন্তু তৃতীয় টায়ারের কারখানায় সাব-কন্ট্রাক্টের কাজ চলাকালে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ব্র্যান্ড খুব সহজে “বেআইনী”ভাবে সাব-কন্ট্রাক্টের কাজ দেয়া হয়েছে দাবী করে নিজেদের দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারবে।

ক্লেইনের মতে, ইউনিয়ন, আইন, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও নাগরিক আন্দোলনের মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রের কর্মপরিবেশে যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব, অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্সের মত কর্পোরেট কোড অফ কন্ডাক্ট সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। বিগত শতকের বিশ এবং তিরিশের দশকে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক আলোচনার মূখ্য বিষয় ছিলো কর্মপরিবেশ, শিশুশ্রম এবং শ্রমিকের স্বাস্থ্য। এই বিষয়গুলোর উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে ইউনিয়ন, শ্রমিক ও মালিকের মাঝে প্রত্যক্ষ দরকষাকষি এবং নতুন নতুন কঠোর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। একইভাবে বর্তমানেও স্থানীয় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে শ্রমিকের কাজের পরিবেশের পরিবর্তন আনা সম্ভব। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মত সংগঠনগুলো মুক্ত বাজার অর্থনীতির জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে যতটা আগ্রহী, আন্তর্জাতিক শ্রমবিষয়ক চুক্তি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের অন্য ততটা আগ্রহী নয়। কর্মপরিবেশের অবস্থা কেমন হওয়া উচিত সেটি আইন এবং সরকারের পরিবর্তে এখন নির্ধারণ করছে বিভিন্ন প্রাইভেট কোড। বহুজাতিক কর্পোরেশান প্রণীত কোড অফ কন্ডাক্ট কোন গণতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত আইন নয়। এটি কর্পোরেশানগুলোকে নিজেদের সুবিধামত একটি প্রাইভেট আইনব্যবস্থা তৈরির এবং সেই আইনের অধীনে সুবিধামত নিজেদের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয়। ক্রমে কর্পোরেশানগুলো জাতিরাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপন করে নিজেরাই আংশিক জাতিরাষ্ট্রের মত আচরণ করতে শুরু করে (ক্লেইন, ৪৩৭)। ক্লেইনের পর্যবেক্ষণটি অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্সের ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য। অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্সকে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার পরিস্থিতি উন্নয়নের চূড়ান্ত নির্দেশনা হিসেবে ধরে নিলে বস্তুগত পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা খুবই কম। শ্রমিকের জীবনযাত্রা ও কাজের পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তন করতে হলে একদিকে সরকার ও আইএলও কর্তৃক প্রণীত কঠোর ও প্রগতিশীল আইন অনুযায়ী শ্রমিকের জন্য কাজের যথাযথ শর্ত, নিরাপত্তা, সুবিধা ও পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার, অন্যদিকে কর্পোরেশানগুলোরও যেকোন মূল্যে সবচেয়ে সস্তা শ্রম খোঁজার নীতি থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র
Barrie, Leonie. “Bangladesh Safety Accord Still Raises Questions.”, last modified 15 May 2013, accessed 31 May 2014, http://www.just-style.com/comment/bangladesh-safety-accord-still-raises-many-questions_id117852.aspx.

Bearnot, Edward. “Bangladesh: A Labor Paradox.” World Policy Institute, accessed 11 March, 2014, http://www.worldpolicy.org/journal/fall2013/Bangladesh-Labor-Paradox.

Brooks, Ethel. 2007. “Children, Schools, and Labored Questions.” In Unraveling the Garment Industry: Transnational Organizing and Women’s Work, 1-25. Minnesota: University of Minnesota Press.

Clean Clothes Campaign and Maquila Solidarity Network. “The History Behind the Bangladesh Fire and Safety Accord.”, last modified 8 July 2013, accessed 2 June 2014, https://www.google.com/url?sa=t&rct=j&q=&esrc=s&source=web&cd=2&cad=rja&uact=8&ved=0CDEQFjAB&url=http%3A%2F%2Fwww.cleanclothes.org%2Fresources%2Fbackground%2Fhistory-bangladesh-safety-accord%2Fat_download%2Ffile&ei=Xa6LU7yMO9iQuATqjICIDg&usg=AFQjCNFB6Bsmin9h2w3vTQ-1rTdNPqOREA&sig2=6gYl6biySR8bQJQ_-Qaj8w.

Dhaka Tribune. 16 May 2014. “Accord Under Fire for Not Paying Jobless RMG Workers.” Dhaka Tribune.

Greenhouse, Steven. “Europeans Fault American Safety Effort in Bangladesh.” New York Times., last modified 18 November 2013, accessed 31 May 2014, http://www.nytimes.com/2013/11/19/business/international/europeans-fault-american-safety-effort-in-bangladesh.html?_r=0.

Gunther, Marc. “GAP Spearheads New Alliance for Bangladeshi Worker Safety.” The Guardian, last modified 11 July 2013, accessed 31 May 2014, http://www.theguardian.com/sustainable-business/gap-alliance-bangladeshi-worker-safety.
Klein, Naomi. 2000. No Logo. Canada: Vintage.

Marian, Petah. “What does the New Bangladesh Safety Accord Entail?”, last modified 14 May 2013, accessed 31 May 2014, http://www.just-style.com/comment/what-does-the-new-bangladesh-safety-accord-entail_id117835.aspx.

Maurer, Roy. “Public, Private Sectors Take Action to Improve Worker Safety in Bangladesh.”, last modified 29 August 2013, accessed 31 May 2014, http://www.shrm.org/hrdisciplines/safetysecurity/articles/pages/worker-safety-bangladesh.aspx.

McCauley, Lauren. “Critics Blast US Retailers’ Corporate-Dominated Factory Safety “Sham”.” Common Dreams, last modified 11 July 2013, accessed 31 May 2014, http://www.commondreams.org/headline/2013/07/11-0.

Ovi, Ibrahim Hossain. 2014a. “Accord & Alliance to Meet Buet Engineers Tomorrow to Solve Disputes.” Dhaka Tribune, 14 May 2014.

———. 2014b. “Accord and Buet Close to Consensus.” Dhaka Tribune, 16 May 2014.

———. 2014c. “Accord Flouts Deal to Skip Remediation Expenses.” Dhaka Tribune, 6 May 2014.

Shayon, Sheila. “US Retailers Detail Implementation of Controversial Bangladesh Safety Plan.” Brand Channel, last modified 21 August 2013, accessed 31 May 2014, http://www.brandchannel.com/home/post/2013/08/21/US-Bangladesh-Safety-Plan-Implementation-082113.aspx.

নাফিসা তানজীম, পিএইচডি গবেষক, রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র

Leave a comment

Trending