ঠোঁটকাটার পাঠকদের জন্য ৫ এপ্রিল তুলে ধরেছিলাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আমার দেখা বাঁশখালী উন্নয়নের সহযোদ্ধা কিছু গরীব, চাষী, দিনমজুরদের অবস্থা। এখন আজকের (৬ এপ্রিল, ২০১৬) আপডেট দিচ্ছি।
আজকে তেল-গ্যাস-কয়লা খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, চট্টগ্রাম এর কয়েকজন গন্ডারমারা হত্যাকান্ডটা সরেজমিনে তদন্ত করতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। দলে প্রায় তের জন বাম রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন। তাদেরকে মূলত গাইড করছিলেন বাঁশখালী উপজেলার একজন স্কুল শিক্ষক যিনি নিজেও মার্কসবাদী এক দলের এক নেতা। আমিও এই দলে ছিলাম।
সাগর পাড়ের ভেড়িবাঁধ আর খালের মাঝখানের চর এলাকা হল এই গন্ডারমারা। লবন, চিঙড়ি আর ধান চাষ হয় এখানে। জলকদর খালের ওপরের খাড়া ব্রিজটা পার হয়ে কয়েকটা ছোট চায়ের দোকানে কয়েকজন নানা বয়সী লোক ছিল। আমরা তাঁদের দেখে আমাদের মোটরবাহন থেকে নামলাম। লোকজন আমাদের চারপাশে জড়ো হয়ে হড়বড় করে সব বলতে থাকলো। সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে আমরা গ্রামের ভেতরে ঢুকতে থাকলাম। যমুনা টেলিভিশনের লাইভ চলছিল বলে একটা বড় জটলা একটু সামনেই আমরা পেলাম। পথে যেতে যেতে আমাকে যে ছেলেটি পাকড়াও করলো তার বয়স ১৬-১৭ এর মত। তার গালে ছ্যাঁচড়ানোর দাগ জ¦লজ¦ল করছিল। তার গল্পটি নিম্নরুপ:
: (আমাদের একজন সঙ্গীর মোটর সাইকেল দেখিয়ে) তারা তো এইভাবে মোটর সাইকেলে করেই এসেছিল আর এরকম হেলমেট পরে…যারা সেদিন আমাদের গুলি করেছিল….তাদের সাথে পুলিশ ছিল…এরা এস আলমের গুন্ডা”
প্রশ্ন: কিভাবে তাদের চিনলেন যে তারা এস আলমের গুন্ডা?
: তারা পুলিশের পোশাক পরে এসেছিল, মুখে মুখোশ ছিল …কিন্তু আমরা এলাকার মানুষ…আমরা এস আলমের গুন্ডাদের চিনি না? তারা তো এখানে প্রায় সময়ই আসে।
(তার পাশ থেকে একজন যোগ করেন) আসবার সময় এস আলমের অফিসটা দেখেছেন না? সেখানে অন্তত ২০০০ টা পুলিশের পোষাক আছে। এগুলা পরেই গুন্ডারা এখানে আসছে। ঐখান থেকেই গাড়িতে ওঠে।
প্রথম জন : এখানে থানায় ২০/২৫ জনের মত পুলিশ থাকে। কিন্তু আসছে অন্তত ২০০ জনের মত
(পাশ থেকে কয়েকজন মন্তব্য করে) ওসি, ইউএনও, এমপি সাহেব সব বেচা গেছে (এস আলমের কাছে)…
চারপাশে সবাই একসাথে ঘটনার বর্ণনা করছে, আমরা কারা, কোত্থেকে এসেছি কেন এসেছি এসব জেরাও করছে এরই মধ্যে একজনের বর্ণনা শুনে আমার গতকালের প্রথম দেখা আহত ব্যক্তিটির কথা মনে পড়ে। আমি জিজ্ঞেস করি, “ এখানে একজন দোকানদার গুলি খাইছে না?” সবাই একসাথে বলে,
“হ, হ… এই যে তার দোকান… মদিনা…তার পায়ে (কাছ থেকে ধরে) গুলি করে এখান থেকে টানতে টানতে ঐ ব্রিজের উপর তুলছে। পাকার উপর টানছে না, তাই অনেক ব্যাথা পাইছে… পাকিস্তান হানাদার বাহিনীও এতো বর্বর ছিলো না…মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এতো অত্যাচার হয়নি…”
লক্ষ্য করলাম আমরা এখনও মূল গোলাগুলির জায়গা স্কুল মাঠটি থেকে কিছুটা দূরেই অবস্থান করছি। এর মধ্যেই জাতীয় কমিটির কাফেলা তাদের সংহতি প্রকাশ মূলক বক্তৃতা ও মিছিল সম্পন্ন করে।
তারপর কে যেন প্রস্তাব করে আমাদের আহতদের দেখতে যাওয়া উচিত। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে চট্টগ্রামের জাতীয় কমিটি এই ঘটনার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিল না। দ্রুত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এই চলে আসা। কয়েকদিন হল মাত্র তাঁরা এই এলাকায় আসা যাওয়া করছেন। কাউকে ঠিকমত চেনেন না তাই এখানে এসে কি কি করবেন তেমন কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তাদের ছিল না। উপস্থিত সকলে মিলে আমাদের নিয়ে গেলেন মরিয়ম আর কুলসুমের কাছে।
এখানে সকলে সম্মিলিতভাবে যে গল্পটি বলেন তা হল:
পুলিশ যে শুধু এলোপাথাড়ি গুলি করে কতগুলো নিরীহ লোককে মেরেছে তাই নয়, উপরন্তু তারা ঘরে ঘরে ঢুকে মহিলাদের গুলি করেছে। কুলসুম তো তার দুধের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিল আর মরিয়ম জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছিল বাইরে কি হচ্ছে যখন তাদের ঘরে ঢুকে গুলি করা হয়। আহতদের নিয়ে প্রধান সমস্যা হল তাদের হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া। ৩০০০ অজ্ঞাত লোকের নামে মামলা হয়েছে এই ভিত্তিতে হাসপাতালে গেলেই পুলিশ গ্রেফতার করছে। এই গ্রেফতারের ভয়ে লোকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে যেতে পারছে না বা গেলেও নিজেদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখছে।
মরিয়ম তার গুলিতে আহত হাত দেখান। তাঁর হাত থরথর করে কাঁপছে। চোখ ছলছল। তিনি আমাকে বলেন, “কুলসুম ৪ মাসের গর্ভবতী। আর পাঁচটা বাচ্চা তার জীবিত। সবগুলা ছোট ছোট। কে তাদের দেখে! মা ছাড়া বাচ্চাগুলো”।
তারপর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্য মহিলারা মিলে আমাকে কুলসুমের পরিবারের একটি ছবি সাজিয়ে দেন।
কুলসুমের স্বামী সহ তার বাচ্চারা।
কুলসুমের স্বামীকে আমি জিজ্ঞেস করি, “কি অবস্থা আপনার রোগীর”?
: “ গ্রেফতারের ভয়ে আমি হাসপাতাল যাইনি। রাস্তায় (গ্রাম থেকে বেরুবার রাস্তায়) বের হলেই তো পুলিশ ধরবে।…ওনার (কুলসুমের) ভাই আছে এখন সাথে। তারাই দেখভাল করছে।”
উল্লেখ্য যে এঁরা সাবই দিনমজুর। হয় কৃষিকজ, না হয় লবন চাষ, না হয় সাগরে মাছধরা এই কাজগুলো তাঁরা করে থাকেন।
অনেকে জাতীয় কমিটির সদস্যদের ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে কোথায় কি অবস্থায় গুলি হয়েছে সেগুলো দেখায়। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে এরপর যাওয়া হয় স্কুল মাঠটির দিকে যেটি হল মূল গোলাগুলির ঘটনাস্থল। আমি মিছিল না করে চুপচাপ হাঁটতেই থাকি। আমার সাথে আলাপে যোগ দেয় কুলসুমের স্বামী সাথে আরও ৫-৬ জন লোক।
আমার প্রশ্ন: মারামারিটা লাগলো কেন? এখানে হইছেটা কি?
আবারও আমাকে বোম্ববার্ট করা হল একগাদা উত্তরে। আমি সংক্ষেপে লিখছি আমি যা বুঝেছি সেগুলো।
: ৩ তারিখ (রাত ১২ টার পর কিন্তু নতুন তারিখ, বুঝিয়ে দেয় একজন) ভোররাতে পুলিশ এসে কতগুলো মানুষকে গ্রেফতার করে। তারা ভেড়িবাঁধের ওপর ঘুমাচ্ছিলো। সেই কারণেই আমরা (লিয়াকত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে) প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছিলাম আর পুলিশ এসে আমাদের উপর নির্বিচারে গুলি করে।
প্রশ্ন: কিন্তু পুলিশ এসে গ্রেফতার করলো কেন?
: কে বা কারা বিদ্যুৎ প্রজেক্টের গাড়ি ভাংচুর করেছে। সাংবাদিকগুলো একটাও ঠিকঠাক খবর লিখে না। ৩-৪ জন এর মধ্যে আসছে, আমাদের সাথে কথা বলছে কিন্তু এস আলমের টাকা খেয়ে সব মিথ্যা লিখছে। গাড়ি ভাঙ্গার কথা তারা নিউজ করেছে কিন্তু এইটা বলে নাই যে আমরা এখানে (কয়লা) তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চাই না।
প্রশ্ন: কিন্তু তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হইলে আপনাদের অসুবিধা কি?
: আরে কয়লা পোড়াইলে তো অনেক ক্ষতি…সুন্দর বনে একটা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতেছে না? সেইটা হইলে গাছ মরে যাবে, বাঘ মরে যাবে…কিচ্ছু থাকবে না…সেইরকম অবস্থা এখানেও হবে। আমাদের গাছপালা থাকবে না, কৃষি থাকবে না। আমাদের চলে যাইতে হবে। আমাদের বাপ-মায়ের কবর এখানে, ভিটা এখানে আমরা কই যাবো? কেন যাবো? তুই (এস আলম) এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে তো পারবি না, ঢুকতেই পারবি না। এই নিয়া তো অনেক দিন ধরে গন্ডগোল চলতেছে। বেশী হইতেছে এই গত দুই-তিন মাস হইলো।
: (পাশের থেকে একজন) তুই আপারে কিছুই বুঝাইতে পারতাছোস না। শোনেন আপা সব গন্ডগোল হল ভাগের টাকার কারণে। সেদিনও তো এমপি সাহেবের বাসায় এই নিয়ে দুই পক্ষে মারামারি হয়েছে। মাঝখান দিয়া এই নিরীহ মানুষগুলা মরলো। আমি আজকে ৩৮ বছর আওয়ামী লীগ করি। এই যে এমপি হইছে এরে তো আওয়ামী লীগের কেউ চিনেই না। এরা (এমপি সাহেব) শুধু টাকা চিনে….
কথা ঘুরে যায়। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাস্তার আশেপাশের দেয়ালে, টিনে গুলির দাগ দেখাতে। বোঝা যায় এখানে এলোপাথাড়ি গুলি করা হয়েছে।
আমার মাথায় প্রশ্ন আসে পুলিশ কি খুব আতংকে ছিল যে তাদের গ্রামবাসী আক্রমন করবে? নব হেল এভাবে এলোপাথাড়ি গুলি কেন? কিন্তু প্রশ্ন করার আগেই আমরা স্কুল মাঠে পৌঁছে যাই। জাতীয় কমিটি এরই মধ্যে একটি তাৎক্ষনিক সমাবেশ শুরু করে দিয়েছেন মাঠটিতে। আমাকে লোকজন দেখাতে থাকে গুলি আর রক্তের দাগ- “এই যে দেখেন”, “এদিকে আসেন”…

” মর্তুজ নানা এই রুটিটা খাইতেছিলেন আমার দোকানে বসে। উনি এই রুটি শেষ করতে পারেন নাই। ওনার বুকে বন্দুক ঠেকায়া গুলি করছে”
আবারও আমি লোকজনের নানা দিক থেকে বলা গল্পগুলো শুনতে থাকি। বুঝতে চেষ্টা করি- কেন পুলিশ আক্রমন করেছে? কতজন পুলিশ ছিল? কত রাউন্ড গুলি পুলিশ এখানে ব্যবহার করেছে পাবলিককে আক্রমন করতে?
গল্পগুলোর ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করে বোঝা যায় যে পাবলিক দাবী করছে তারা ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে সে সম্বন্ধে জানতো না। পুলিশের এ্যাকশন তাই তাদের আচমকা লেগেছে। পাবলিকের ভাষ্য মোটামুটি এরকম, “ আমরা তো কোন অস্ত্র (বল্লম, টোঁটা ও লাঠি এই অঞ্চলে ঘরে ঘরেই থাকে) নিয়েই যাই নি। মিটিং হবে শুনেছি, মিটিং শুনতে গিয়েছি। আমরা যদি প্রস্তুত হয়ে যেতাম তাহলে একটা পুলিশও সেদিন জান নিয়ে এখান থেকে পালাতে পারতো না”।
আবারও আমাকে অভিযোগ করা হয় যে ৪ এপ্রিলের আক্রমনে পুলিশ ও আনসারের পোশাকে এখানে এস আলমের গুন্ডা বাহিনী গুলি করেছে। আমার সামনেই সেদিন যারা উপস্থিত ছিলেন তারা নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি করলেন আসলে কতজন পুলিশ সেই দিন আসল পুলিশ ছিল। মোট ২০০ জন পুলিশ এর মধ্যে কেউ বললেন ৫০ জন, কেউ বললেন ৭০ জন ছিল আসল পুলিশ ছিল আর বাকিরা ছিল এস আলমের গুন্ডা। প্রথমে তারা আকাশের দিকে গুলি করে, প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে তারা। মোট ১০০০ রাউন্ড গুলি চলে সেদিন, বলেন এই প্রত্যক্ষদর্শীরা।
আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিনা যে পুলিশের পোশাক এস আলমের গুন্ডারা গায়ে চড়িয়েছে। প্রশ্ন করি আবার : কিভাবে চিনলেন এস আলমের গুন্ডা তারা?
আবার সবাই একসাথে কথা বলতে শুরু করলো।
: ওদের পরনে মুখোশ ছিল (কারণ তারা কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছিল এ্যাকশনের সময়)…মুর্তজা আর আংকুরকে তো ওরা গুলি করেছে কাছে থেকে কারণ ওরা তাদের চিনে ফেলেছিল, মুখোশ টেনে খুলে ফেলেছিল…
: আর আমরা তো স্থানীয়…আমরা তাদের চিনি…এস আলমের অফিস থেকেই তারা গাড়িতে উঠেছে (এই একই কথা আমি আরেকজনের কাছেও শুনেছিলাম একটু আগে)…ঐখান থেকেই তারা গাড়ীতে ওঠে, ঐখানেই থাকে।
: ধুর…ঐগুলা পুলিশই…ইউএনও, ওসি সব ছিল…(বেআইনী ভাবে তাই পুলিশের পোশাক পুলিশ নয় এমন কেউ পরতে পারে না)
আমি: তাহলে হয়তো এরা পুলিশই…
: এরা (পুলিশ ও স্থানীয় প্রসাশন) মাফিয়া ডন (এস আলম) দের হয়ে কাজ করছে…এস আলমের টাকা খেয়ে পুলিশ গুলি করেছে…
বাংলাদেশের মানুষের পুলিশ প্রশাসনের ওপর অনাস্থা, অবিশ্বাস, ক্রোধ, ক্ষোভ আমি যে এই প্রথমবার লক্ষ্য করেছি তা নয়। ফুলবাড়ি কয়লা খনি বিরোধী আন্দোলনকারীদের সাথে গবেষণা কাজ করতে গিয়েও আমি দেখেছি পুলিশ, প্রশাসন, সরকার নিয়ে তাদের এরকমই ভয়াবহ সব অভিযোগ।
জাতীয় কমিটি এর মধ্যে তাদের তাৎক্ষনিক সমাবেশ শেষ করে ফেলে আমাকে ডাকতে থাকে। লিয়াকত চেয়ারম্যান এই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন কিন্তু আমার মনে হয় জাতীয় কমিটি তার সাথে যোগাযোগ করতে চাইলো না। তারা বরং আগ্রহী নিহতদের আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ করতে, তাই আমরা সেটাই করলাম।
এই ফাঁকে বলে নিই যদিও জায়গাটির নাম গন্ডামারা লিখছে সবাই কিন্তু এলাকাবাসীর সাথে আলাপ করে আমার মনে হল জায়গাটার নাম আসলে গন্ডার-মারা হওয়া উচিত ছিল। হয়তো সেটাই ছিল এর আসল নাম পরে মুখে মুখে হারিয়ে গেছে গন্ডার এর র। এলাকার নামকরণ নিয়ে জিজ্ঞেস করলে এলাকাবাসী জানায় এক সময় এই এলাকা জঙ্গল (চকোরিয়া সুন্দরবন ম্যারগ্রোভ ফরেস্টের অংশ) ছিল এবং জনবসতি স্থাপন করতে এখানে অনেক গন্ডার মারা পড়েছিল, সেই মগ রাজাদের (আরাকান শাসনামল) সময়। সেই থেকেই এই নাম।
নিহতদের বাড়ি কই জিজ্ঞেস করতে করতে আমাদের মোটর বাহন চলতে থাকে এবং একটা জায়গায় এলাকাবাসীর অনুরোধে তাদের কথা শুনতে আমাদের থামতে হয়। আমাদের জন্য পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা উপস্থিত ছিলেন। আমি নারীদের দিকে এগুতেই আবার সবার একসাথে পুলিশ ও কয়লা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে ক্ষোভ, ক্রোধ ও আপত্তি জানানো শুরু হয়।

আমার দুই মামা মারা গেছে, মামাতো বোনের স্বামী মারা গেছে। আমাকেও মেরে ফেলুক তবু আমরা কয়লা বিদ্য়ুত চাই না। আমাদের উপর পাকিস্তানী হানাদার আবহিনীর মত অত্য়াচার করতেছে। আমাদের বাপ-ভাই-স্বামী পুলিশের ভয়ে রাতে ঘরে ঘুমাতে পারে না, বিলে বিলে ঘুমায় তারা। আর পুলিশের পোশাক পরে আসামী ধরার নাম করে এরা ঘরে ঢুকছে , আমাদের অলংকার, মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে। আমরা ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না।
এই সময় আমি উপলব্ধি করি যে একই পরিবারের তিনজন মারা গেছেন একসাথে। এতাক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম মৃত আনোয়ারুল ইসলাম আর মর্তুজ আলী ছিলেন আপন দুই ভাই আর জাকির হোসেন ছিলেন মর্তুজ আলীর মেয়ের জামাই। আর্দ্র চোখ নিয়ে মেয়েরা আমাকে ফরিয়াদ জানাচ্ছিল আর আমি ভাবছিলাম, “এক পরিবারে এতোগুলো মৃত্যু…কিভাবে শোক সামলাচ্ছে এই মানুষগুলো…প্রশাসন, সরকার, ব্যাবসায়ীরা এদের দেখছে জঞ্জাল হিসেবে, উন্নয়নের বাধা হিসেবে…আমরা দেখছি প্রতিবাদকারী হিসেবে কিন্তু আমরা এঁদের মানুষ ভাবছি তো? আমার বাবা, ভাই, মামা, চাচা, দাদা, স্বামী, ছেলে পুলিশের গুলিতে না মরে স্বাভাবিকভাবে মরলেও কি আমার সমান শোক হবে না এখন ওনাদের যেমন হচ্ছে…শেষ পর্যন্ত তো আমরা মানুষই…সবাই এক, শোকের অনুভূতিও আমাদের সমান…”
মৃত আনোয়ারুল ইসলাম, মর্তুজ আলী আর জাকির হোসেনের বাড়ি গিয়ে জাতীয় কমিটির নেতারা বাড়ির পুরুষদের সাথে আলাপে বসেন। আমাকে ঘরের ভেতর নিয়ে যায় বাড়ির মেয়েরা। কান্নাকাটি আহাজারির রোলের মধ্যেই বাড়ির বড় বউটি আমার পরিবার, লেখাপড়া, স্বামী-সন্তান সকলের খবরাখবর জেনে নেন, মাশাল্লাহ বলেন, আপ্যায়ন করেন শরবত, বিস্কুট আর কমলা দিয়ে। আমার পানির বোতল খালি হয়ে গেছে খেয়াল করে পানি ভরে দেয় বাড়ির এক কিশোরী। এর মধ্যেই আমাকে জানানো হয় আনোয়ারের ছেলে আরাফাত বাপকে বাঁচাতে গিয়ে ছররা বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আমরা চলে গেলে ওর চাচু ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।
এই বাচ্চা ছেলেটার মনের মধ্যে কি চলছে, কিভাবে এই শোক সামলাচ্ছে সে ভাবতে গিয়ে আমার বোনের মেয়েটার কথা মনে হয়। বাবা বাবা করে তার কত আল্লাদ, কত বায়না….
গন্ডার-মারায় ৫০০ একর জায়গা আছে। এস আলম গ্রুপ এরই মধ্যে ১৭শ কানি জায়গা কিনেছে (জমির হিসাবে আমি কাঁচা তাই এ্যাক্যুরেসিতে যাচ্ছিনা)। ঝামেলাটা জমি কেনা বেচা নিয়ে নয় বার বার পরিষ্কার করেন আমাকে উত্তর দাতারা। কারণ প্রজেক্টের জন্য এস আলমের জমি কেনা শেষ। টাকা পয়সাও যারা জমি বেচেছে তারা পেয়ে গেছে। এখন যারা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারা জমিদার লোক নয়, খেটে খাওয়া লোক। তাদের কথা সামান্যই – কয়লা বিষক্রিয়ায় যে মাটি, পানি, গাছপালার ক্ষতি হবে তাতে তো এই এলাকায় আর বসবাস করা যাবে না কিন্তু তারা কই যাবে? কি করে খাবে? দুইটা রথ (শরীরের কর্মক্ষমতা) ছাড়া তো তাদের সম্বল আর কিছু নাই।
আর আমার দাবীও সামান্য়ই – ১. এই যে এলাকাবাসী দাবী করছেন যে পুলিশ নিরীহ লোকদের আক্রমন করেছে তার তদন্ত হওয়া দরকার, দোষীদের শাস্তি হওয়া দরকার। ২. পুলিশের পোশাকে কি আসলেই গুন্ডারা এসেছিল? প্রশাসন কি আসলেই এস আলমের প্রাইভেট বাহিনীর মত কাজ করছে? তদন্ত চাই আমি এর। নাগরিক হিসেবে পাবলিক সারভেন্টদের এইসব ক্রিমিনাল কাজকারবারের তদন্ত ও শাস্তি চাই ৩. অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামী করে এই যে গ্রামবাসীদের ধর পাকড় হয়রানি করা হচ্ছে এইসব হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
শেষ করবো এক নিহতের ছেলের উক্তি দিয়ে। জাতীয় কমিটির নেতারা তাকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলে স্বান্তনা দেবার, শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি উত্তর করেন:
“ওনাকে মেডিকেলে নিলে বাঁচানো যেত। পুলিশ নিতে দেয় নাই। আইনের লোককে অনেক সম্মান দেখানো হইছে। আর না।”
Categories: আন্দোলন বার্তা
Leave a Reply