পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিহাসের অন্য পাঠ: যুগতারা দেওয়ানের জীবন পর্ব ৪(শেষ পর্ব )
ঃ সমারী চাকমা
পিনন-খাদির একাল সেকাল
ছোটবেলা থেকে দেখেছি আমার নানু মা ঘরে বাইরে পিনন পরছে। তখন শুধু দুই রং এর পিনন খাদি দেখা যেত। কালোর সাথে লাল পাড় । তবে মাঝে মাঝে আমি দেখতাম, লাল পাড়ের বদলে গোলাপী পাড় দিয়ে পিনন-খাদি। আমরাও বড় হবার সময়ে পিনন খাদি পরতাম। তখনতো স্কুলে ছাত্রীরাও পিনন খাদি পরে স্কুলে যেতো। যারা কাজের কারণে অফিসে যেত বা অন্য কোথাও তারাও পিনন খাদি পরতো। এসব আমাদের এখানে দেখা।
কিন্তু মাঝের সময়টা যে কি হল, পিনন খাদি পরা হঠাৎ করে কমে গেল। সবাই শাড়ী পরা শুরু করেছে আমি আমার বন্ধুরাও মাঝে মাঝে শাড়ী পরতে শুরু করলাম। তখন মনে হতো পিনন খাদি আর থাকলো না। আসলে তখনকার পরিস্থিতি এরকমই ছিল। কিন্তু এখন আবার সবাই পিনন-খাদি পরতে শুরু করেছে। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে সব বয়সী মেয়েরা পিনন-খাদি পরছে দেখতে খুব ভালো লাগে। আসলে এক্ষেত্রে ভান্তেদের অবদান অনেক। ভান্তেরা সবসময় অনুরোধ করেন মেয়েরা যেন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পিনন-খাদি পরে যান। মারমা মেয়েরা কি সুন্দর করে তাদের ড্রেস পরে থাকে সবসময়। আর ত্রিপুরা মেয়েরা, বাজার বারে মানে হাট বাজারের সময়ে যখন দূর-দূরান্ত থেকে ত্রিপুরা মেয়েরা বাজারে আসে তখন ওরা কি সেজে গুজে চুলে ফুল দিয়ে ওদের কালারফুল পিনন-খাদি(রিনা-রিসাই) পরে আসে দেখতে এতো সুন্দর লাগে। অবশ্য শুধু দেখতে সুন্দর বলে না, এটাতো আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ, জীবনের অংশ। আমি সবসময় সব জায়গায় নিজের ড্রেস পরতে ভালবাসি। ভারতে ত্রিপুরা রাজ্যে শরর্নাথী হিসেবে থাকাকালীন আমাকে শরনার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে। আমি স্বাচ্ছন্দের সাথে প্রত্যেকটি জায়গায় পিনন-খাদি পরে প্রতিনিধিত্ব করেছি। এখনতো দেখি পিনন-খাদি কত ফ্যাশনেবল হয়ে গেছে। আগে আমরা কোমর তাঁেত বোনা পিনন-খাদি ছাড়া অন্য কোন কিছু ব্যবহার করতামনা। আর সবই ছিল সুতির চিকন, মোটা সুতো দিয়ে পিনন-খাদি বোনা হতো। তারপরতো আমরা ত্রিপুরার শরনার্থী শিবিরে নানান রকম ফুল দিয়ে বোনা পিনন-খাদি প্রচলণ করি । নানা ধরণের রঙ দিয়ে পিনন খাদি হতে থাকে এবং সেখানে আমরা আরেক কোয়ালটিরি সুতো খুঁজে পাই যার স্থানীয় নাম কোরিয়ান সুতা। অনেক টেকসই দেখতেও সুন্দর কিন্তু পরতে একটু গরম লাগে। তারপরও এই কোরিয়ান সুতার ফুল দিয়ে বোনা পিনন-খাদি খুব জনপ্রিযতা লাভ করে। এখন রেয়ন/সিল্ক সুতো দিয়ে কি সুন্দর সুন্দর পিনন-খাদি হচ্ছে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। আর তাঁতের সুতির পিনন- খাদি পরতে যেমন আরাম তেমনি রঙটাও বশে চোখে পডে। আসলে সময়ের সাথে সাথে কত কিছু বদলে যায়। আমরা যৌবণ কালে যা ভাবতে পারিনি এই শেষ বয়সে কত কিছু দেখছি। এটাই হয়তো জীবন।

সুতির পিনন-খাদি, এই খাদিটাকে ফুলের খাদি বলা হয়ে থাকে। এটি অনেক প্ুরোনো ডিজাইন এর পিনন খাদি

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থী শিবিরের সামনে পিনন খাদি পরা দু’জন চাকমা নারী। নতুন ডিজাইনের ফুল দিয়ে বোনা পিনন-খাদিটি এই শরনার্থী শিবিরেই প্রথম বোনা হয় কোরিয়ান সুতা দিয়ে।

এটি নতুন ধরনের খাদি। রেয়নের সুতো আর জরি দিয়ে বোনা।

সাধারনত পিননে একটা চাবুগী থাকে। দুটো চাবুগী দিয়ে পিনন বোনা খুবই সাম্প্রতিক।

একধরনের সুতা যার নাম কোরিয়ান সুতা- সেই সুতা দিয়ে বোনা কালারফুল পিনন-খাদি। এটি খুবই টেকসই কিন্তু একটু গরম।

এটি একেবারে পুরাতন ডিজাইন দিয়ে তৈরী খাদি। এখন এই ফুল দিয়ে খাদির মাথা বোনা হয়না বললেই চলে।

৭০,৮০ দশকের সময়ে বা তারও আগে হতে চলা এই ডিজাইনের খাদি এবং কারুকার্যময় সুতীর বাঁধন( খাদির মাথার শেষের সুতো)এখন নেই বললেই চলে।

বর্তমান সময়ে বহুল জনপ্রিয় এবং দামী কালারফুল পিনন-খাদি।
লেখকের নোট : র্পাবত্য চট্টগ্রামের র্দীঘ স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে পাহাড়ী নারীদের অংশগ্রহণ এবং অবদান সীমাহীন। যদিও পাহাড়ি নারীরা এখনো তাদের সামাজিক পারিবারিক উত্তারাধিকার হতে বঞ্চিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারী ও শিশু র উপর সেটেলার বাংগালীদের দ্বারা প্রতিনিয়ত যৌণ সহিংসতা, ধর্ষণ এবং খুন যেন জীবনের অংশ হয়ে দাড়িঁয়েছে। ্রএবং তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্ষ্ঠপোষকতায়। এইসব ধারাবাহিক ভাবে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার বিচার আজো হয়নি। তাই পাহাড়ি নারীর যেমন খুবই কঠিন এখন। যেহেতু পারিবারিক এবং সামাজিক ভাবেও আজো অবহেলিত ও বঞ্চিত।
অন্যভাবে যদি দেখি পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধিকার আন্দোলন নিয়ে যেসব দলিল পত্র দেখা যায় বা লেখা হয়েছে সেখানে পাহাড়ি নারীদের উল্লেখযোগ্য অবদানের কথা আমরা দেখতে পাইনা। পাহাড়ি নারীদের বীর গাঁথা কোথাও নেই। অথচ এইসব আন্দোলনে নারীরাই সবচেয়ে ভিকটিম। সমাজে নানা কথ্য আলোচনায় শুধু শোনা যায় নারীরা কি পরিমান কষ্ট করেছে আন্দোলনে কিভাবে অংশ নিয়েছে নিজের জীবনকে বাজি রেখে। কিন্তু সেসব কোথাও দলিল হিসেবে লেখা নেই। তাই লেখক নিজ তাগিদে পাহাড়ি নারীদের এই অসামান্য অবদানকে তুলে ধরতে এবং র্পাবত্য চট্টগ্রামে লুকিয়ে থাকা হাজারো নারীর অসামান্য বীর গাঁথাকে সকলের সামনে তুলে আনতে এই ধারাবাহিক সিরিজের কাজটি শুরু করেছিলেন এক সংগ্রামী নারী যুগতারা দেওয়ানের সাথে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে। ২০১৭ সালের কোন এক সময় প্রায় ৪/৫ দিন ধরে ধারাবাহিক ভাবে এই আজীবন সংগ্রামী নারীর সাখে আলাপ,গল্প হয়েছে। কত লুকানো সংগ্রাম, ত্যাগ, কত সামাজিক বেদনার ইতিহাস শোনা আর জানা হলেও লেখক এইখানে লিখতে পেরেছে খুব কম ঘটনা। কারণ সব কিছু লেখার সময় এখনো আসেনি। তাই আড়ালেই রাখতে হয়েছে অনেক শোনা কথা। অনেক সীমাবদ্ধতার পরও এই কাজটি শেষ করতে পারা লেখকের জীবনে জন্য এটি একটি বড় কাজ । এই সংগ্রামী নারীর সাথে আলাপ না হলে লেখকের জানা হতো না নারীদের সংগ্রামী দিকটি, শরর্নাথী শিবিরের জীবন যাপন নারীদের শরীরে মনে কিভাবে প্রভাব ফেলেছিল কিভাবে বদলে দিয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন।
উল্লেখ্য যে ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পযর্ন্ত ৬০ হাজারেরও বেশী পাহাড়িকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এক যুগ (১২ বছর) ব্যাপী শরনার্থী হিসেবে থাকতে হয়েছিল। সেই সময় শরনার্থী শিবিরে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সারা জীবনের জন্য হারিয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষের সম্ভাবনাময় জীবন। অন্যদিকে পাহাড়িদের ফেলে আসা জায়গা জমি গ্রাম সব বেদখল করে নিয়েছে সেটেলার বাঙালীরা। সেসব আজো ফেরত পাওয়া যায়নি। সেই বাস্তব র্নিমম ইতিহাস এখন কেউ মনেও করতে চাইনা, রাখতেও চাইনা। কিন্তু সত্য সব সময় সত্য। র্পাবত্য চট্টগ্রামের লুকায়িত সত্যকে সামনে তুলে ধরার লেখকের এটি একটি ছোট্ট প্রয়াস মাত্র।
লেখক এখানে চাকমাদের কিছু পিনন-খাদির ছবি দিয়েছেন। সময়ের সাথে তাল মেলাতে যেন পিনন-খাদি বোনা, পরা সবকিছুতেই বদল ঘটেছে। সুতি থেকে কোরিয়ান সুতো তারপর রেয়ন তারপর তাঁতে বোনা হালকা পিনন-খাদি এখন পাওয়া সহজ। পিনন-খাদির পরার ষ্টাইল/ধরন ও বদল ঘটেছে। এই কয়েকটি ছবি দেয়া হচ্ছে একটু ধারনা দেয়া।
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ, যাপিত জীবন
Leave a Reply