আলোকচিত্র: বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি

নাফিসা তানজীম

২০২০ সালের মে মাসের এক তারিখে উদযাপিত হওয়া আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসটি ছিল অন্যান্য বছরের শ্রমিক দিবসগুলোর তুলনায় অনেকখানি আলাদা। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ সারা বিশ্বকে এবার কাঁপিয়ে দিয়েছে। খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা এমনিতেই পৃথিবীর সর্বত্র বৈষম্যের শিকার। বৈশ্বিক মহামারী তাদের অবস্থাকে আরো নাজুক করে তুলেছে। এবার মে দিবসে আমেরিকার অ্যামাজন, হোল ফুডস, ইন্সটাকার্ট, ওয়ালমার্ট, ফেডেক্স, টার্গেট আর শিপ্টের মত বড় বড় কর্পোরেশনের শ্রমিকেরা গণ প্রতিবাদ আয়োজন করেছে। করোনা মহামারীর মাঝেও এই কোম্পানিগুলো তাদের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য এবং বেতন-ভাতার নিরাপত্তা দেয়নি। শ্রমিকেরা তাই  মে দিবসে কাজ বয়কট করেছে এবং ভোক্তাদের ওইদিন এসব কোম্পানির কাছ থেকে কেনাকাটা না করতে অনুরোধ করেছে।

ঐতিহাসিকভাবে  শ্রমিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার মোটামুটি সফল একটা কৌশল হলো একটা বিশেষ লক্ষ্যবস্তু ঠিক করা এবং তাকে উদ্দেশ্য করে সংগঠিত হওয়া। মে দিবসে আমেরিকায় এবার শ্রমিকেরা যে পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ আয়োজন করলো, সে ধরণের অবস্থায় একটা বিশেষ লক্ষ্যবস্তুকে টার্গেট করে সংগঠিত হওয়ার কৌশল বেশ কাজে দেয়। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা যখন স্থানীয় থেকে বৈশ্বিক অঙ্গনে চলে যায়, যখন শ্রমিকেরা উৎপাদন করে এক দেশে আর তাদের উৎপাদন করা পণ্য বিক্রি হয় আরেক দেশে – তখন এত সহজে আর একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে সংগঠিত হওয়া্র কৌশলটি পুরোপুরি কাজে দেয় না।

যেমন ধ্রুন পোশাকের সাপ্লাই চেইনের কথা। পোশাকের সাপ্লাই চেইনে প্রতিবাদ করাটা অ্যামাজনের শ্রমিকদের অ্যামাজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মত সোজা-সাপ্টা বিষয় নয়। পোশাকের সাপ্লাই চেইনে কর্পোরেশান আছে, সরকার আছে, পোশাক কারখানার মালিকরা আছে, আছে অনেক অনেক মধ্যস্বত্ত্বভোগী। এই জটিল সাপ্লাই চেইনে যদি শুধু কোন বিশেষ একটা লক্ষ্যকে টার্গেট করা হয়, তখন ফাঁক দিয়ে অন্য লক্ষ্যবস্তুগুলো পার পেয়ে যায়। ব্র্যান্ডকে শুধু টার্গেট করলে পোশাক কারখানার মালিকদের সুবিধা। কারখানার মালিকদের শুধু টার্গেট করলে ব্র্যান্ডদের পোয়াবারো। শ্রম আন্দোলনের এই নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্যকে টার্গেট করার প্রবণতাকে অনেকে বলেছেন “স্পটলাইট অ্যাপ্রচ” (লক ২০১৩, কবির এবং অন্যান্য ২০১৯)। নব্বইয়ের দশক থেকে এখন পর্যন্ত পোশাক শ্রমিকদের জন্য যতগুলো আন্তর্জাতিক আন্দোলন হয়েছে, তাদের প্রায় সবগুলোই কোন একটা বিশেষ লক্ষ্যবস্তুকে স্পটলাইটে এনে আন্দোলন করেছে। এর ফলে স্পটলাইটের বাইরের অন্য লক্ষ্যবস্তুগুলো সহজে পার পেয়ে গেছে। শ্রমিকদের অবস্থারও ব্যাপক কোন উন্নতি হয়নি।

অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধবসের পরে অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের শ্রম অধিকার সংগঠন এবং সংগঠকরা  অ্যাকর্ডকে “মেজর ব্রেকথ্রু” বা “গেম চেঞ্জার” বলে অভিহিত করেন। তাদের বেশিরভাগই অ্যাকর্ডের সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করে অ্যাকর্ড কীভাবে অ্যালায়েন্সের চেয়ে অনেক বেশি ভালো, সেটা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত ছিলেন। অ্যাকর্ড অবশ্যই অ্যালায়েন্সের চেয়ে অনেক ভালো মডেল ছিল। অ্যালায়েন্স ছিল শুধু একটা কর্পোরেট কোড অফ কনডাক্ট যেটা কর্পোরেশনের জবাবদিহিতার অথবা শ্রমিকদের অংশগ্রহণের তেমন কোন ব্যবস্থা রাখেনি।

কিন্তু অ্যাকর্ড ও অ্যালেয়ন্স দুটোই পোশাক কারখানার মালিক, পোশাক শ্রমিক এবং শ্রমসংগঠকদের জন্য অনেক কনফিউশান তৈরি করে। অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স দুটোই হলো একধরণের বেসরকারী শাসনব্যবস্থা। দুটোই “নিরাপত্তা”র খুব সংকীর্ণ সংজ্ঞা নিয়ে কাজ করে। তারা মূলত ফোকাস করে ভবন এবং অগ্নি নিরাপত্তার ওপরে। কিন্তু জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম মজুরির নিরাপত্তা, চাকুরির নিরাপত্তা, যৌন হয়রানি থেকে নিরাপত্তা – এইসব নিরাপত্তার দিকে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স কোন মনোযোগ দেয়নি (হক ২০১৯)। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স মোট ২৩০০ কারখানার প্রায় বিশ লাখ শ্রমিককে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু লোকাল মার্কেটে পোশাক সাপ্লাই দেয়া এবং বড় পোশাক রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে অর্ডার নেয়া প্রায় ৩০০০ হাজারের বেশি সাবকন্ট্রাকটর কারখানায় অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কোন কার্যক্রম ছিল না (নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি – স্টার্ন সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ২০১৮)।

বাংলাদেশের যেসব শ্রমিক সংগঠন অ্যাকর্ডের সাথে জড়িত ছিল, তাদের হয় রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ছিল, না হয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনগুলোর সাথে ভালো যোগাযোগ ছিল। যোগাযোগবিহীন, বিদেশী ফান্ডবিহীন, এনজিও মডেলের বাইরে কাজ করা তৃণমূল শ্রম সংগঠনগুলোর বৈশ্বিক অ্যাকর্ড ক্যাম্পেইনের সাথে তেমন কোন যোগাযোগ ছিল না।

ব্র্যান্ড নাকি কারখানার মালিক?: স্থানীয় ও বৈশ্বিক আন্দোলনের মতপার্থক্য

তৃণমূল, ক্ষুদ্র, বিদেশী ফান্ডিং ছাড়া বাংলাদেশের ভেতরে কাজ করা শ্রম সংগঠনগুলো সাধারণত পোশাক কারখানার মালিক এবং সরকারকে লক্ষ্য করে শ্রমিকদের সংগঠিত করে। কিন্তু বৈশ্বিক শ্রম আন্দোলনের কাজের পদ্ধতি স্থানীয় আন্দোলনের কাজের ধরণের চেয়ে বেশ আলাদা। ইউরোপ-আমেরিকার শ্রম সংগঠনগুলো বাংলাদেশের শ্রমিকদের আন্দোলনে সমর্থন জানানোর জন্য তাদের কাজ শুরু করে বড় বড় রিটেইলর ও ব্র্যান্ডগুলোকে লক্ষ্য করে। এইসব ব্র্যান্ড বহুদিন ধরে বলে এসেছে পোশাক শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব তাদের না। তাদের মতে মূল দায়িত্ব নিতে হবে সরকার এবং পোশাক কারখানার মালিকদের। কিন্তু এই ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের শ্রমিকদের সস্তা শ্রমকে ব্যবহার করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা করে। তাই ব্র্যান্ডগুলোকে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ এবং অধিকার রক্ষার জন্য চাপ প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি।

কিন্তু এই চাপ প্রয়োগ করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাগুলো প্রায় সময়েই ভুলে যায় যে বাংলাদেশের সরকার এবং পোশাক কারখানার মালিকরাও পোশাক শ্রমিকদের সস্তা শ্রমকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাগুলো প্রায়ই বাংলাদেশ সরকার এবং পোশাক কারখানার মালিকদের “নির্দোষ” বা “অসহায়” হিসেবে বেনিফিট অফ ডাউট দেয়। এর ফলে বৈশ্বিক এবং স্থানীয় আন্দোলনের লক্ষ্য এবং অগ্রাধিকারের মধ্যে বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়।

বৈশ্বিক এবং স্থানীয় শ্রম সংগঠনের অগ্রাধিকারের এই ব্যবধানের খুব ভালো একটা উদাহরণ হলো ২০১৪ সালের তুবা আন্দোলন। ওই বছরের আগস্ট মাসে তুবা গ্রুপের প্রায় ১৬০০ শ্রমিকের তিনমাসের বেতন-ভাতা না দেয়ার প্রতিবাদে শত শত শ্রমিক তুবার কারখানায় অবস্থান নিয়ে অনশন ধর্মঘট শুরু করে। শ্রমিকদের আন্দোলনকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভয়াবহভাবে দমন করা হয়। অনেক শ্রমিকনেতাকে প্রহার করা হয়। অনেকে গ্রেফতার হন। অথচ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের সমর্থন দেয়ার জন্য একটা-দুটো বিবৃতি দেয়া ছাড়া তেমন কিছু করা হয়নি। আন্তর্জাতিক মিডিয়াও এই আন্দোলনকে তেমন করে কাভার করেনি। অথচ একই সময়ে তারা সবাই তখন অ্যাকর্ড ক্যাম্পেইনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। একইভাবে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ন্যূনতম মজুরির দাবীতে যখন শ্রমিকেরা আন্দোলন করেছে, তখনও আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনগুলো অ্যাকর্ড ক্যাম্পেইনের মত করে শ্রমিকদের সমর্থন দেয়নি।

করোনাকালে শ্রম সংগঠন

বৈশ্বিক করোনা মহামারী পোশাক শিল্পের জন্য একটি নজিরবিহীন সংকট তৈরি করেছে। বিজিএমইএর ওয়েবসাইট অনুযায়ী মে মাসের ৩ তারিখ পর্যন্ত ১১৫০ পোশাক কারখানার ৩.১৮ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্ডার বাতিল অথবা স্থগিত করা হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, ফোর্বস, ফরচুন, এনপিআর, রয়টার্স, আল-জাজিরা এবং ওয়াশিংটন পোস্টের মত বড় বড় গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মালিক এবং শ্রমিকদের অবস্থার কথা তুলে ধরেছে। ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন, ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইটস ফোরাম, ম্যাকুইলা সলিডারিটি নেটওয়ার্ক এবং ওয়ার্কার্স রাইটস কনসর্শিয়াম করোনা মহামারীর সময়ে ব্র্যান্ডগুলোকে সাপ্লাই চেইনের শ্রমিকদের দায়িত্ব নেয়ার আহবান জানিয়ে একটি জয়েন্ট স্টেটমেন্ট ইস্যু করেছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনগুলো যেভাবে ব্র্যান্ডগুলোকে অর্ডার বাতিল এবং স্থগিত করার জন্য সমালোচনা করছে, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু তাদের পুরো উদ্যোগে যে ব্যাপারটি লক্ষণীয়, তা হলো তাদের বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মালিক এবং সরকারকে নির্দোষ ও অসহায় হিসেবে তুলে ধরবার প্রবণতা। বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট রুবানা হক ওয়াশিংটন পোস্টে ১৮ই এপ্রিলে প্রকাশিত একটি অপ-এডে লিখেছেন যে ব্র্যান্ডদেরকে শ্রমিকদের প্রতি তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন, এনজিও ও অ্যাকাডেমিশিয়ানদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। হতাশাজনক ব্যাপার হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত সুধীসমাজ ব্র্যান্ডদেরকে সমালোচনা করবে, বিজিএমইএ খুশি থাকবে। সমালোচনা যখন একটুখানি ঘুরে বিজিএমইএর দিকে আসছে, তখন তারা আর সেটা হালকাভাবে নিচ্ছে না।

বিজিএমইএ এবং নিওলিবারেলিজম

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডেইলি স্টারে এপ্রিলের ১৩ তারিখে প্রকাশিত নাদিন শান্তা মুর্শিদের লেখাটির কথা। নাদিন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ বাফেলোর সমাজ কর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি তাঁর আর্টিকেলে বৈশ্বিক কোভিড মহামারীর বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখেছিলেন। বৈশ্বিক পুঁজিবাদ, সামাজিক দূরত্বের ধারণাটির সীমাবদ্ধতা, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রস্তুতি, শ্রমিকদের প্রতি জেন্ডার এবং শ্রেণী বৈষম্য এবং সরকার ও বিজিএমইএর ভূমিকার সমালোচনা করেছিলেন। বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট রুবানা হক স্বয়ং ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবাদলিপি পাঠান। সেই প্রতিবাদলিপিতে তিনি নাদিনকে বিজিএমইএর জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ব্যাপক সুনাম নষ্ট করে অপবাদ দেয়ার দায়ে অভিযুক্ত করেন। নাদিন বিজিএমইএকে সরকারি লকডাউনের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করার সমালোচনা করেছিলেন। এর প্রতিবাদে বিজিএমইএ বলে যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, এফবিসিসিআই, বিইএফ, বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ সবাই মিলে কারখানা খোলা রাখার যৌথ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রুবানা হক মনে করিয়ে দেন যে যেসব কারখানার পারচেজ অর্ডার ছিল এবং যেসব কারখানা পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) তৈরি করছিল, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের খোলা রাখার নির্দেশনা ছিল।

বিজিএমইএ বলতে চাচ্ছে যে, নাদিনের দাবী অনুযায়ী বিজিএমইএ শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেছে – কথাটি সঠিক নয়। সিদ্ধান্তটি “যৌথভাবে” নেয়া হয়েছে। তার মানে বিজিএমইএ, সরকার এবং অন্যান্য বড় বড় সংস্থার সাথে মিলিতভাবে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। দোষ বিজিএমইএর একার না – এটা খুব শক্ত কোন যুক্তি নয়। উপরন্ত, “বিজিএমইএ একা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না” – এই যুক্তি দেয়ার সময় তারা যেটা বারবার ভুলে যায় অথবা ভুলে যেতে চায়, তা হলো বিজিএমইএ বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের ওপরে তাদের বড়ধরণের প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। বিজিএমইএর অনেকে সরকারী বিভিন্ন পদে নির্বাচন করেছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের  অনেক সদস্য হয় পোশাক কারখানার মালিক অথবা পোশাকশিল্পের সাথে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত। শ্রমিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে বিজিএমইএর ঐতিহাসিক ভূমিকাও খুব একটা সুবিধার না।

রুবানা হক আরো লিখেছেন যে বিজিএমইএকে নিওলিবারেলিজমের দায়ে অভিযুক্ত করা হঠকারী ও অবিবেচনাপূর্ণ। নিওলিবারেলিজমের অ আ ক খ অনুযায়ী নিওলিবেরালিজম হলো এমন একটি দর্শন এবং পলিসি মডেল যা মুক্তবাজার অর্থনীতি, বাণিজ্যিক উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ এবং স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসির মত পলিসিগুলোকে সমর্থন ও বাস্তবায়ন করে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প, শিল্প মালিক এবং বিজিএমইএ আশির দশক থেকে টিকেই আছে মুক্তবাজার অর্থনীতি, বাণিজ্যিক উদারীকরণ এবং স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসির ওপরে ভিত্তি করে। এই অবস্থায় কেউ যদি বলে বিজিএমইকে নিওলিবেরালিজমের দায়ে অভিযুক্ত করা হঠকারী ও অবিবেচকের মত আচরণ, তবে তার নিওলিবারেলিজম সম্পর্কে আদৌ কতটুকু জ্ঞান আছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে।

সরকার কী করছে?

বিজিএমইএ যেহেতু দাবী করেছে এটা তাদের একার দোষ না – এবং এই দাবী কিছুটা সঠিকই – তাহলে দেখা যাক সরকারের দোষ এখানে কতটুকু। ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এপ্রিলের ২৩ তারিখে ফেসবুকে “রানাপ্লাজার সাত বছরঃ করোনার ঝুঁকি এবং শ্রমিকের অবস্থান” শীর্ষক আলোচনায় বলেন যে ঝামেলা শুরু যখন সরকার “সাধারণ ছুটি” ঘোষণা করে, তখন থেকে। করোনা মহামারীর প্রেক্ষিতে আইনগত দিক থেকে এই “ছুটি” “কমিউনিকেবল ডিজিজেজ (প্রিভেনশান, কন্ট্রোল অ্যান্ড ইরাডিকেশান) অ্যাক্ট ২০১৮” নাকি “ডিজঅ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট ২০১২”-এর অধীনে ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা সরকারের নির্দিষ্ট করে বলে দেয়া উচিত ছিল – যেটা সরকার করেনি।  ভারতে “ডিজঅ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট”-এর অধীনে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এই আইনে বলাই আছে যে কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের লেঅফ করতে পারবে না। আমরা জানিনা বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃতভাবে কাজটা করেছে। কিন্তু এই দুটো আইনের বাইরে গিয়ে “সাধারণ ছুটি” ঘোষণা করায় সরকার এখন আর আইনত শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য কাউকে বাধ্য করতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ৩১ দফা নির্দেশনায় বলা হয় যে, “শিল্পমালিকগণ শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে উৎপাদন অব্যাহত রাখবেন।” এখন শিল্পমালিক আর শ্রমিক এক টেবিলে বসলেও তাদের মধ্যে ক্ষমতার বিশাল ব্যবধান থাকে। এছাড়া স্বাস্থ্য সুরক্ষা ঠিক কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, কোন কোন প্রটোকল সবাই মানতে হবে – সে ব্যাপারেও কোন ষ্পষ্ট নির্দেশনা সরকার দেয়নি। এই অষ্পষ্টতার সুযোগ নিচ্ছে সরকার এবং মালিকপক্ষ দুই পক্ষই। সরকার বলতে পারছে মালিকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর মালিকপক্ষ ও বিজিএমই বলতে পারছে আমরা একা কিছু করিনি। তারা সরকারের কাছ থেকে যে নির্দেশনা পেয়েছে তা অত্যন্ত অষ্পষ্ট। তারা নিজেদের মত করে সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছে এবং তাতে প্রচুর ফাঁক-ফোঁকর থেকে যাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটার মাশুল দিচ্ছে শ্রমিকেরা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যারা বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য ব্র্যান্ডগুলোর কাছে দাবী জানাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগেরই স্থানীয় শ্রম রাজনীতির এইসব প্যাঁচ সম্পর্কে ধারণা নেই।

আমরা যদি ধরেও নেই যে ব্র্যান্ডগুলো পোশাক শ্রমিকদের দায়িত্ব নেবে এবং কারখানার মালিকদের অর্ডার ক্যানসেল বা স্থগিত করবে না, তাহলেই কি এই মহামারীর সময়ে শ্রমিকদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? ব্র্যান্ডদের দেয়া টাকা চুঁইয়ে চুঁইয়ে শ্রমিকদের পৌঁছবে – সেই গ্যারান্টি কে দেবে? শ্রমিকদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তার নিশ্চয়তা কে দেবে? তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে কি সবেতন ছুটি পাবে? তারা কি সময়মত বেতনভাতা ও ঝুঁকি ভাতা পাবে?

অর্থনীতি নাকি জীবন?

একদিকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ও কারখানার মালিকদের জন্য ভালো খবর হলো এশিয়ান বায়াররা তাদের দেশগুলোতে অর্থনীতি চালু হওয়ায় অর্ডার নিতে শুরু করেছে (ফাইনান্সিয়াল টাইমস, ৩০শে এপ্রিল ২০২০)। গত সপ্তাহে প্রায় ২০০০ কারখানা খুলে গেছে। আরো কয়েকশ কারখানা আগামী কিছুদিনের মধ্যে খুলে যাবে (ইকোনমিস্ট, ৩০শে এপ্রিল ২০২০)। অপরদিকে মার্চের ২৫ তারিখ থেকে প্রায় ৩৯ জন পোশাক শ্রমিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। কয়েকজন মারাও গিয়েছেন (কালের কন্ঠ, ৩রা মে ২০২০)। মে দিবসে সাভারে শতাধিক পোশাক শ্রমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। তাদের মধ্যে ৫০ জনকে বাছাই করে পরীক্ষা করে ৮ জন করোনা রোগী পাওয়া যায়। এই ৮ জনের ৭ জনই পোশাক শ্রমিক (প্রথম আলো, ১লা মে ২০২০)। কারখানাগুলো খোলার পর থেকে করোনার কমিউনিটি সংক্রমণের হার বাড়ছে। পুলিশ করোনা রোগীদের বাসার এলাকাগুলো লক ডাউন করে দিচ্ছে। কিন্তু যেসব কারখানায় এই রোগীরা কাজ করতো, সেই কারখানাগুলো কিন্তু সব খোলা আছে এবং সেগুলোতে পুরোদমে উৎপাদন চলছে। ফলে কারখানার ভেতরে যারা করোনারোগীদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের কোয়ারেন্টাইন করার কোন পদক্ষেপ নেয়া যাচ্ছে না।

করোনাকালের আন্তর্জাতিক শ্রম আন্দোলন বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং পোশাকশ্রমিকদের চাকরি-বেতন-জীবিকা রক্ষার ওপরে স্পটলাইট ফেলতে গিয়ে তাদের স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে গেছে। শুধু ব্র্যান্ডদের ওপরে স্পটলাইট ফেলতে গিয়ে তারা বাংলাদেশ সরকার, বিজিএমইএ এবং পোশাক কারখানার মালিকেরা কীভাবে শ্রমিকদের নিপীড়ণ করছে, সেটা পুরোপুরি উপেক্ষা করে গেছে।

অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে জীবনকে অবহেলা করবার ভয়াবহ পরিণাম আমরা হয়তো অল্প কিছুদিনের মধ্যেই টের পাবো।

নাফিসা তানজীম যুক্তরাষ্ট্রের লেযলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল স্টাডিজ ও উইমেন, জেন্ডার, অ্যান্ড সেক্সুয়ালিটি স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক। লেখাটি লেখকের নিউ এইজে প্রকাশিত “From Rana Plaza to COVID-10 Pandemic: Spotlights of Transnational Labor Organizing” শীর্ষক প্রবন্ধের বাংলা ভাবানুবাদ।

 

Leave a comment

Trending