“ওয়েট! কি জানি কইতাছিলাম ভাই?”
গত ১৩ মে মহাখালীর বিসিপিএস মিলনায়তনে চিকিৎসক ও নার্সদের যোগদান অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক বলেন যে করোনাকে তেমন কোন ভয়ানক রোগ বলে তিনি মনে করেন না! (বাংলা নিউজ টোয়েন্টি ফোর, ১৩ মে ২০২০)। শুধু এটুকু বলেই তিনি ক্ষান্ত হন নি। তিনি ওই অনুষ্ঠানে চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে আরো বলেন, “করোনাভাইরাস আপনাদের জন্যে আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে। কারণ কভিড-১৯ যদি না আসতো আপনাদের হয়তো নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হতো না।” তিনি যোগ করেন, “কাজেই কভিড আপনাদের জন্যে একটি আশীর্বাদ হিসেবেই এসেছে…কভিডের কারণেই আপনারা এ নিয়োগ পেয়েছেন।” (দেশ রূপান্তর, ১৩ মে ২০২০)। করোনাভাইরাস আর কোন দেশে এরকম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সম্মুখীন হয়েছে কিনা সেটাও একটা আগ্রহোদ্দীপক গবেষণার বিষয় হতে পারে।
মাত্র ৭দিন অনলাইন অনুসন্ধান চালিয়ে, গত ১০ মার্চ ২০২০ থেকে ২০ মে ২০২০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, স্থানীয় দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহ থেকে সারা দেশে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করার যত অভিযোগ পাওয়া গেছে সেই সংখ্যা এবং বিনা চিকিৎসার ঘটনার ধরণসমূহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ থেকে এটা পরিস্কার যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা বলতে যতটুকু অবশিষ্ট ছিল সেটাও এখন তছনছ হওয়ার পথে, হয়ত তছনছ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বস্তুত সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন অসুস্থ হলে চিকিৎসা না পাওয়ার আতংক প্রবলভাবে বিরাজমান। উল্লেখ্য, চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর ফোকাস রাখার প্রয়োজনে, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ বলতে এখানে সেসব ঘটনাকেই বোঝানো হচ্ছে যেগুলোর ক্ষেত্রে রোগী চিকিৎসা চেয়েও পাননি। যেসব ক্ষেত্রে রোগী ঘরে বসে ছিলেন এবং চিকিৎসা নিতে কোথাও না গিয়ে বা চিকিৎসার ব্যাপারে কোন উদ্যোগ না নিয়ে (পত্রিকার রিপোর্টের ভিত্তিতে) ঘরে বসে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেসব ঘটনাকে সঙ্গত কারণেই এই রিপোর্ট তৈরি করার সময় বিনা চিকিৎসার আওতা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টসমূহ থেকে ১০ মার্চ- ২০ মে ২০২০ – এই দুই মাস ১০ দিনে সারা দেশে অন্তত ৪১টি জেলায় সর্বমোট অন্তত ১২২ জনের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে! এক্ষেত্রে অন্তত বলার কারণ হল: প্রথমত, সকল জাতীয় ও প্রধান প্রধান স্থানীয় দৈনিকের খবর দেখা সম্ভব হয়নি এবং দ্বিতীয়ত সকল ঘটনা পত্রিকায় রিপোর্ট হয় না। জেলাওয়ারী এই হিসাবটি তৈরি করার সময় রোগী কোন জেলার অধিবাসী ছিলেন সেটা বিবেচনায় না নিয়ে বরং যে জেলাতে এসে তিনি বিনা চিকিৎসার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন সেটিকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এছাড়াও পুনরাবৃত্তি এড়াতে বিভিন্ন রিপোর্টে প্রকাশিত ঘটনার তারিখ, ব্যক্তি ও স্থানের নামের দিকে খেয়াল রাখা হয়েছে।
বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর জেলাওয়ারী হিসাব (১০ মার্চ – ২০ মে ২০২০):
উপরোক্ত সময়ের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ঢাকা জেলায়। ঢাকা জেলার ক্ষেত্রে অন্তত ৩৯ জনের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে, যার প্রায় সবগুলোই ঘটেছে খোদ রাজধানীতে। তবে এই ৩৯ জনের সবাই যে ঢাকা জেলা বা রাজধানীর বাসিন্দা ব্যাপারটি সেরকম নয়। এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে চিকিৎসা না পেয়ে রাজধানীতে এসেছিলেন চিকিৎসার আশায়। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিনা চিকিৎসাতেই মরতে হয়েছে।
বিনা চিকিৎসায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে চট্টগ্রামে অন্তত ১২ জন ও তৃতীয় সর্বোচ্চ খুলনায় অন্তত ১১ জন। উপরোক্ত সময়ে নারায়ণগঞ্জে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৫টি।
এছাড়াও উপরোক্ত সময়ে,
অন্তত ৩ জন করে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে এমন জেলাগুলো হচ্ছে:
কিশোরগঞ্জ, নোয়াখালি, যশোর, কুষ্টিয়া ও বগুড়া।
অন্তত ২ জন করে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে এমন জেলাগুলো হচ্ছে:
শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, পাবনা, বরিশাল ও সিলেট।
এবং অন্তত ১ জন করে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে এমন জেলাগুলো হচ্ছে: ফরিদপুর, গাজীপুর, মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নড়াইল, মাগুরা, বরগুনা, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রাম।
বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনাসমূহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ (১০ মার্চ – ২০ মে ২০২০):
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে উপরোক্ত সময়ের মধ্যে ঘটা এই ১২২টি বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনাসমূহকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণকারীরা এককভাবে সবচেয়ে বেশি যে ঘটনার শিকার হয়েছেন তা হল করোনা আতঙ্কে হাসপাতালে ভর্তি না নেয়া। এই ১২২ জনের মধ্যে অন্তত ৪৬ জনের ক্ষেত্রেই এই ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়াও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করার অভিযোগ থাকা এই ১২২ জনের মধ্যে,
- হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরও করোনা আতঙ্কের কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে চিকিৎসা দেয় নি এমন ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন অন্তত ৩২ জন।
- হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার বা প্রয়োজনীয় চিকিৎসাকর্মী পাননি এমন ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন অন্তত ৩১ জন।
- আইসিইউ পাননি অথবা আইসিইউ খালি না থাকার শিকার হয়েছেন অন্তত ২০ জন।
- কোভিড সার্টিফিকেট না থাকায় হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি এমন ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১৬ জনের ক্ষেত্রে।
- করোনা আতঙ্ক ছাড়াও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা না দিয়ে বসিয়ে রেখেছে এমন ধরনের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১২ জনের ক্ষেত্রে।
- হটলাইনে, প্রশাসনের কাছে সাহায্য চেয়েও পাননি, স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দীর্ঘসূত্রিতা, করোনার টেস্ট রিপোর্ট আসতে দেরি হওয়া এজাতীয় ঘটনার শিকার হয়েছেন অন্তত ১১ জন।
- এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঠেলাঠেলি করা হয়েছে এ জাতীয় ঘটনার শিকার হয়েছেন অন্তত ৮ জন।
- নন-কোভিড সার্টিফিকেট না থাকায় হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন নি সুনির্দিষ্টভাবে এমন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গেছে অন্তত ৬ জনের ক্ষেত্রে।
- হাসপাতালে যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকা/ অক্সিজেন সংকটের শিকার হয়েছে অন্তত ৩ জন।
- করোনা ধরার পড়ার পর চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়া/ হাসপাতাল থেকে ভর্তি থাকা রোগীকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৪ জনের ক্ষেত্রে।
- রাস্তায়/ বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন, চিকিৎসার জন্য কাতরাচ্ছিলেন, কিন্তু করোনা আতংকে কেউ এগিয়ে এসে হাসপাতালে পাঠায়নি এমন ধরনের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৩ জনের ক্ষেত্রে।
- করোনাকালীন সময়েও হাসপাতাল নির্ধারিত ল্যাব থেকে টেস্ট না করানোয় ভর্তি না করা তথা বেসরকারী হাসপাতালের বাণিজ্যের শিকার হয়েছেন অন্তত ২ জন।
- এছাড়াও অন্তত ১ জন করে শিকার হয়েছেন এমন ঘটনাগুলো হল: হাসপাতালে করোনা রোগী থাকায় ভর্তি হতে না পারা, করোনা পরিস্থিতির অযুহাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জটিল অপারেশন করতে না চাওয়া, হাসপাতালে নেয়ার সময় করোনা আতঙ্কে এলাকাবাসীর বাধাপ্রদান, করোনার চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত থাকার অযুহাত তুলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অন্য রোগীকে ফিরিয়ে দেয়া, করোনা আতংকে রোগীর স্বজন কর্তৃক রোগীকে হাসপাতালের মাঠে ফেলে রেখে চলে যাওয়া, রোগীর স্বজনরা অসুস্থতার খবর গোপন করে চিকিৎসা করাতে যাওয়া।
বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করা এই ১২২ জন উপরে বর্ণিত যেসব ঘটনাগুলোর শিকার হয়েছেন সেগুলোকে মোটা দাগে ৪টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সারসংক্ষেপ টানা যায়। এই চারটি ক্যাটাগরি হল: হাসপাতালে ভর্তি না নেওয়া, হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসা না পাওয়া, স্বাস্থ্য বিভাগ/ প্রশাসনের গাফিলতি এবং চিকিৎসায় এলাকাবাসী ও স্বজনদের অবহেলা/ বাধা প্রদান।
মোটা দাগে এই ৪ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, গত ১০ মার্চ থেকে ২০ মে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার অভিযোগ থাকা এই ১২২ জনের মধ্যে,
- হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভর্তি নেয় নি এ জাতীয় ঘটনার শিকার হয়েছেন অন্তত ৮৪ জন।
- হাসপাতালে ভর্তির পর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাননি এ জাতীয় ঘটনার শিকার হয়েছেন অন্তত ১০২ জন।
- স্বাস্থ্য বিভাগ/ প্রশাসনের গাফিলতি ছিল এ জাতীয় ঘটনার শিকার হওয়ার অভিযোগ এসেছে অন্তত ১১ জনের ক্ষেত্রে।
- রোগীর চিকিৎসায় এলাকাবাসী/ স্বজনরা অবহেলা করেছেন বা বাধা দিয়েছেন এজাতীয় ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৩ জনের ক্ষেত্রে।
বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর বিস্তারিত টাইমলাইন এখানে।
বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর জেলাওয়ারী টাইমলাইন [৮ মার্চ ২০২০ থেকে ২০ মে ২০২০]
Categories: আন্দোলন বার্তা
Leave a Reply