কবিতা চাকমা, ২১ মে ২০১৫
পুলিশ তদন্ত এগুবে কি করে?
‘যদি না নিখোঁজ জন মূল সাক্ষী হয়ে
তার নিজ অপহরণের সাক্ষ্য দিতে না পারে’
‘কল্পনা চাকমা নিখোঁজ’ তদন্তের
এই হলো পুলিশ সুপারের রিপোর্টের উপসংহার।
সামান্য এক নারী কল্পনা, সে ‘জাতি’ নয়, ‘উপজাতি’
‘উপজাতি’ খোদাই হয়ে আছে জাতীয় মহা-বয়ানে
এটা কোন ব্যাপার নয়, ১২ই জুন ১৯৯৬ সালের প্রথম প্রহরে
নি:সার অন্ধকারে বন্দুক তাক করে নিজবাড়ী থেকে অপহরণ।
অন্ধকার লাল্যেঘোনা,
কাপ্তাই লেকের পাড়ে এক অজপাড়া গাঁ।
লেকটা বানানো হয়েছিলো বৈদ্যূতিক বাতির জন্যে
বেশ আগে, কল্পনার পূর্ব প্রজন্মের ভিটেবাড়ী ডুবিয়ে।
কল্পনাকে অপহরণ করেছিলো তারা
বিধবা বাদনী, অন্ধপ্রায়, কৃশ, বৃদ্ধ মমতাময়ী মা,
আর চারুবালা, কল্পনার লাস্যময়ী, মায়াবতী বৌদির বুক ছিনিয়ে,
সাথে অপহৃত হয়েছিলো স্নেহদাতা কল্পনার দুই ভাই,
কালিন্দী ও ক্ষুদিরাম।
ওদের দু’হাত ছিলো পেছনে টেনে বাঁধা।
ওদের চোখও ছিলো কাপড়ে বাঁধা।
ওদের ঘর থেকে টেনে নেওয়া হলো।
ক্ষুদিরামকে নির্দেশ দেওয়া হলো সম্মুখে হাঁটতে
হোঁচট খেল সে লেকের হাঁটু জলে
যখন নির্দেশ এল তাকে গুলি করার
ঝাঁপ দিলো সে লেকের আশ্রয়ে
কালিন্দীও দৌড় দেয় গুলির শব্দে।
গুলির কানফাটা আওয়াজ তুচ্ছ করে
শোনা গিয়েছিলো কল্পনার আর্ত ডাক ‘দাদা, দাদা’।
অভিযুক্তরা ‘জাতি’ ভুক্ত
শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও চামচা।
সাক্ষী তার দুই ভাই
যারা চিনে ফেলেছিলো কিছু অপহরণকারীর স্বর,
অপহরণকারীর আনা টর্চের আলোয় তাদের কিছু মুখ,
লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস খানের ও নুরুল হক, এক সেটেলারের।
তদন্ত রিপোর্টে ভাইয়েরা মূল সাক্ষী বলে গণ্য নয়,
রিপোর্ট বলে, কল্পনা, নিখোঁজ জনই, মূল সাক্ষী।
কি দরকার এসব নিয়ে চিন্তা করার?
এখন একবিংশ শতাব্দী
১৯৯৬ সাল সুদূর অতীত।
চুলোয় যায় তোমাদের শব্দাবলী,
চুলোয় যাক তোমাদের বিবেচনা,
চুলোয় যাক তোমাদের নৈতিকতা,
চুলোয় যাক তোমাদের মানবিকতা,
চুলোয় যাক সম্পাদকরা,
চুলোয় যাক লেখকরা,
চুলোয় যাক কবিরা,
চুলোয় যাক সাংবাদিকরা,
চুলোয় যাক প্রতিবাদীরা,
চুলোয় যাক বিচার অন্বেষীরা,
চুলোয় যাক, চুলোয় যাক সব।
এখন কল্পনা কর কল্পনাকে
সে এক মহীরূহ নারী,
না, না এ মিথ্যে,
সে নারী নয়,
সে মানুষ নয়,
সে অমানুষ।
এক মানুষ উর্ধব
বা মানুষ নিম্ন জীব।
সে নিখোঁজের রাজ্য থেকে তার অপহরণকারীর অস্ত্র গুড়িয়ে
পুলিশের কাছে এসে তার নিখোঁজের মূল সাক্ষী হতে পারে।
হয়তবা এমন ক্ষমতাও আছে তার, মৃত্যুর পর জ্যান্ত
ফিরে আসার, যদি কখনও তাকে হত্যা করা হয়।
একুশ বছরের এক তরুণী,
অজানা সম্ভাবনার এক নারী।
এক শিক্ষার্থী।
এক পরম বন্ধু।
এক যোদ্ধা।
এক সাধারণ।
সব পরিচয় ফেলে তার পরিচয় আজ ‘নিখোঁজ’।
কিন্তু দুর্দান্ত বিদ্রুপের খোঁচা চষে
উন্মাদ দানবের ভয়াল হাসি হেসে
ও যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম পাহাড় আলোকিত করে আগুনে
আর বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ স্থলভূমি বন্যায় ভাসিয়ে পুষ্ট করে পলি উপত্যকায়
বছরের পর বছর…।
কি স্পর্ধা তোমার, বেহায়া, তুমি আমাদের হৃদয় ভাঙো
কি স্পর্ধা তোমার, বেপরোয়া, তুমি বিচার প্রহসনে প্রশ্ন করো
কি স্পর্ধা তোমার, নির্লজ্জ, তুমি আমাদের নৈতিকতায় আঘাত করো
কি স্পর্ধা তোমার, কলঙ্কিনী, তুমি আমাদের মানবতাকে লজ্জিত করো
কি স্পর্ধা তোমার, অবিবেচক, তুমি জাগিয়ে দাও
ন্যায় বিচারের আকাংখা।
কল্পনা চাকমা, তোমাকে আমাদের ভালোবাসা,
তুমি জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ কালিমা,
তুমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বশ্রেষ্ঠ ভয়।
Categories: আন্দোলন বার্তা, প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, সংস্কৃতি-রাজনীতি
Leave a Reply