সায়দিয়া গুলরুখ ও নাসরিন সিরাজ
যখন আওয়ামী লীগের সরকার টুুঁটি চেপে ধরেছে সকল সচেতন আর প্রতিবাদী কন্ঠস্বরের, যখন ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে প্রতিবাদকারী, বিশেষ করে নারীদের যৌন নিপীড়ন করতে, নারীদের যৌনবাদী গালি দিতে, ধর্ষণের হুমকী দিতে তখন আমরা লিখতে বসেছি, এই লেখা এই সময়ের সকল প্রতিবাদী মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে।
যে কোন নারী যখন ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে কিছু একটা বলছে তৎক্ষনাত তাকে বেশ্যা, খানকী, মাগী বলে ছাত্রলীগ গালি দিচ্ছে :
- যখন প্রধাণমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা দেয়ার পরও কোটা বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করলেন না, বরং ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিলেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দমনের জন্য, তখন তার প্রতিবাদ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী উম্মে হাবিবা বেনজীর সাহসী বক্তব্য দিলে সোশাল মিডিয়াতে তাকে বেশ্যা, মাগী, খানকী ডাকা হল, ডেকেই তারা থামল না, ধর্ষণের হুমকী চলছে ক্রমাগত।
- যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষিকা কোটা আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ক্ষমতার তোষামদী নিয়ে প্রশ্ন করলেন, তার ফেসবুক ওয়াল থেকে শুরু করে গোটা সামাজিক যোগাযোগের দেয়াল জুড়ে তারা ব্যস্ত হল তাকে বেশ্যা সাব্যস্ত করতে।
- যখন তেজগাঁও টেকনিকাল কলেজের ছাত্রী মরিয়ম কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেন তাকে ঠেকাতে বেশ্যা বলে গালি দেয়া হল।
পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রের, সমাজের চোখে যে বক্তব্য “নারীর প্রতি অবমাননাকর” তা আন্দোনলনকারী নারীদের টার্গেট করে ক্রমাগত উচ্চারিত হচ্ছে। যদিও সুশীল সমাজের শ্লীল-অশ্লীলতার বিভাজন দিয়ে গালা-গালির এই ব্যাবস্থাকে আমরা বিচার করি না। আমরা জানি, এই সমাজে গালি বিষমকামী সম্পর্কের হিংস্রতা-বৈষম্য-আকাঙ্খার মতাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই চর্চিত হচ্ছে। গালি খেয়ে, থাপ্পড়ের জন্য গাল বাড়িয়ে না দিয়ে নারীরা যখন পাল্টা গালি দেয়,
- যখন এই হেটেরোসেক্সিস্ট ক্ষমতার ভাষা ক্ষমতাকে ফিরিয়ে দিয়ে সরকার-ছাত্রলীগের দমন-নিপীড়নের প্রতিবাদ করেন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা শামীমা বিনতে রহমান, তৎক্ষনাত তাকে বেশ্যা বলে গালি দেয়া হয়।
চলমান আন্দোলনে প্রতিবাদকারি নারীদের ধর্ষণের হুমকী দেয়া হয়েছে, যৌনাঙ্গে, পায়ূপথে ডিম, গরম লোহা ঢোকানো হবে এরকম নানান রকম ধর্ষণ-কল্পনার ছড়াছড়ি চলছে ফেসবুকে। কোন নারী সংগঠনকে ছাত্রলীগের এই প্রকাশ্য হুমকী নিয়ে বিচলিত হতে দেখলাম না। তারা কেউ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, যিনি নিজে নারী, যিনি উঠতে বসতে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছেন, যিনি বিশ্ব দরবারে চ্যাম্পিওন অব উইমেন্স এম্পাওয়ারমেন্ট খেতাবে অভিষিক্ত, তার কাছে জানতে চাইলেন না, ছাত্রলীগের যৌন সন্ত্রাস তিনি কিভাবে বরদাস্ত করেন? তাদের জিজ্ঞেস করতে শুনিনা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, নারীর ক্ষমতায়ন, বেশ্যাকরণ ও ধর্ষণকে কি একই সঙ্গে অনুমোদন করেন? কোনও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিকে এই হুমকী, নারীদের লাগাতার বেশ্যাকরণের প্রচেষ্টা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে দেখি না। ছাত্রলীগ প্রতিবাদকারীদের “তোর মায়েরে চুদি, তোর বোনেরে চুদি” বিরামহীনভাবে বলে যাচ্ছে সেটায় আপনাদের একটুও আনসেটলিং লাগে না? কিন্তু কোনও নারীর মুখে যৌনাত্মক কটাক্ষ শুনলে আপনাদের অস্বস্তি লাগে? কেন? ক্ষমতাধরদের ভয় পান বলে? পিতৃতান্ত্রিক চেতনায় আঘাত লাগে বলে?
আমরা প্রত্যাখ্যান করি এইসব বালের সুশীল সমাজকে। ইতর শ্রেণীর ভাষা ও জীবন আমরা ডিজওউন করি না। আমরা ভালো মেয়ে আর বেশ্যা মেয়ের মতাদর্শিক বিভাজনকে ডিজওউন করি। বেশ্যাকরণ তখনই সম্ভব যখন এই নৈতিক বিভেদকে মেনে নেয়া হয়। আমরা এই বিভাজন প্রতিরোধ করি। টাকার বিনিময়ে যারা যৌনতা বিক্রি করছেন বনানী, ধানমন্ডি, মিরপুর, পল্টন, মতিঝিল, বাড্ডা…. আপনাদের পছন্দ হোক বা না হোক আমরা/তারা এই সমাজেরই বাসিন্দা। এখানে নারী মা, বোন, স্ত্রী, মামী, চাচী, ফুপু, শিক্ষিকা, সেবিকা, আইনজীবী। নারী বেশ্যাও। আমাদেরকে বেশ্যা গালি দিলে আমাদের কোন সম্মানহানি হয় না।
আমরা বেশ্যা। তো?
Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ, যাপিত জীবন, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ
Leave a Reply