নারীর প্রতিবাদী কণ্ঠকে রূদ্ধ করার জন্য তাকে বেশ্যা, মাগী, সস্তা, দুশ্চরিত্রা ডাকা কিংবা ধর্ষণের শিকার নারীকে বেশ্যা ডেকে সহিংসতা জায়েজ করা পিতৃতান্ত্রিক ইতিহাসে কোনও নতুন ঘটনা নয়। আমরা যারা বাংলাদেশের যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের সাথে বিগত দুইদশক ধরে যুক্ত এইসব সামাজিক খেতাব, মন্দ মেয়ের মুকুট আমরা সানন্দে মাথায় পরেছি।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, আরও স্পষ্ট করে বললে – বর্তমান আওয়ামী আমলে – সরকারি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা মাত্রই ছাত্রলীগ, যুবলীগ, বা -লীগ জাতীয় যে কোনও সংঘ প্রকাশ্যে, বিশেষ করে ফেসবুকে ধর্ষণের হুমকি দেয়, নারীর বিরুদ্ধ মতকে স্তব্ধ করার জন্য তাকে পায়ু পথে গরম রড না গরম ডিম দিয়ে ধর্ষণ করবে এই নিয়ে কমেন্ট-রিপ্লাই-কমেন্ট চালায়। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে “-লীগ” ধর্ষণ-ফ্যান্টাসিতে ফেসবুক সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে নারীপক্ষ ছাড়া মুলধারার নারী সংগঠনগুলো প্রায় সকলেই নিশ্চুপ। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে একটি টকশো আমাদের চোখে পড়ল যেখানে সরাসরি এই বিষয়টিকে এ্যাড্রেস করা হয়েছে। ডিবিসির অন্যপক্ষে ফেসবুকে ধর্ষণের হুমকিকে ভার্চুয়াল যৌনসন্ত্রাস হিসেবে বোঝার চেষ্টা করেছে, যে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন লাকী আক্তার (সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন) এবং ব্যারিস্টার মিতি সানজানা (আইনজীবী, সুপ্রিমকোট)।
ঠোঁটকাটা নারীবাদী ব্লগের পক্ষ থেকে এই চলমান আলোচনায় অংশগ্রহণ করার তাগিদ থেকে আমরা আলাপে বসি। আলাপে অংশগ্রহণ করেছেন নাসরিন সিরাজ, সামিনা লুৎফা ও সায়দিয়া গুলরুখ। পূর্ণাঙ্গ আলাপটি শোনার জন্য নিচের লিংকটিতে ক্লিক করুন (পুরো রেকর্ডিং-এ সাউন্ড একরকম নয়, তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী)।
আমরা মনে করি, ছাত্রলীগের ধর্ষণের হুমকী ও ধর্ষণ ফ্যান্টাসি উৎপাদনকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোনও সুযোগ নেই। যৌনসহিংসতা ও নারীর বেশ্যাকরণকে অনুমোদন বর্তমান আওয়ামী সরকারের শাসনের কৌশলেরই অংশ। এই যে নারীর বিরুদ্ধ কণ্ঠকে ডিলেজিটিমাইজ করার জন্য তাকে বেশ্যা ডাকা হচ্ছে, বা তার চরিত্র হননের চেষ্টা চলছে — রাষ্ট্রের, সরকারের এই যৌনবাদী চরিত্র নিয়ে সিভিল(ইভিল) সোসাইটির বৃহত অংশকে তেমন কিছু বলতে শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন? সে নারী সংগঠন বা সাংস্কৃতিক জগতই হোক। পুরাতন নারী সংগঠনগুলোর মধ্যে একধরণের মধ্যবিত্ত মতাদশিক শূচিবাই আছে — তারা এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে সহজ বোধ করেন না; আর আওয়ামী সাংস্কৃতিক বলয়তো এই বিশ্বাস নিয়েই আছে – “যা কিছু নারীর পক্ষে অর্জন করা হয়েছে তার সবকিছু আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় না কলে নস্যাত হয়ে যাবে।
আরও মুশকিল হল, যখনওবা নীরবতা কেউ কেউ ভাঙ্গছেন, তখন তারা প্রতিবাদী নারীর তথাকথিত চরিত্রহননের চেষ্টা চালাচ্ছে, সে যে কত চরিত্রবান/বতী সেটাই প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। প্রতিবাদী নারী, বা যে কোনও নারীকে, সত্য়ি কথা বলতে এখনও আমাদের সামাজিক আলাপচারিতায় সক্রিয় যৌন সত্ত্বার অধিকারী হিসেবে কল্পনা করা হয় না। নারী সংগঠনগুলো, এমনকি লেফ্টদের মাঝেও নারী মুক্তির যে ভাবনা সেগুলো কিছু বিষয় স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়। যেমন, নারীর যৌন চাহিদা নাই, নারী সব মেনে নেয়, বিয়ের বাইরে যৌন সম্পর্ক করা যায় না, বিয়ে ছাড়া একসাথে থাকা যায় না, ইত্য়াদি। এগুলো নিয়ে এমনকি কথা বলাটাকেও সম্মানজনক ভাবে দেখা হয় না। ফলে শ্লীল-অশ্লীল, ভাল নারী-মন্দ নারী এ’সব দ্বিবিভাজনকে মেনে নিয়েই কেউ কেউ প্রতিবাদ করেন।
তাই আমাদের আলাপ আওয়ামী-সরকারের লিঙ্গীয়-যৌন সহিংস চরিত্র নিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় যৌনতার রাজনীতি, যৌন স্বাধীনতার প্রসঙ্গে।
এই বিষয়ে আমাদের আগের লেখা, সায়দিয়া গুলরুখ ও নাসরিন সিরাজ, আমরা সবাই বেশ্যা, জুলাই ৭, ২০১৮।
Categories: আন্দোলন বার্তা, কথোপকথন, বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply